ইসলামিক বিষয়ের এক বিশাল সমাহার

কিতাবসমূহ

Showing posts with label ইসলামিক পোস্ট. Show all posts
Showing posts with label ইসলামিক পোস্ট. Show all posts

Friday, November 13, 2020

November 13, 2020

করোনা ভাইরাস ও আল্লাহ তা‘আলার হিকমাহ

 


করোনা ভাইরাস ও আল্লাহ তা‘আলার হিকমাহ 


মাসজিদে নববীর জুমার খুতবার বাংলা অনুবাদ [তাং 27.03.2020]

খতীব: শাইখ ড. আলী বিন আব্দুর রহমান হুযাইফা


হে মানবজাতি! আপনারা লক্ষ্য করছেন যে, পৃথিবীবাসীর উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে। তারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন যে, একটি ভাইরাস মানুষকে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত করছে ও দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা খুবই ভায়াবহ। এই ভাইরাসটি যে কোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। তা মানবসভ্যতাকে হুমকি দিচ্ছে।


হে আল্লাহ্! আমাদের সাথে আপনি আপনার দয়া, বদান্যতা, করুণা, ইহসান ও ক্ষমার আচরণ করুন। আমাদের সাথে বদলা ও হিসাব গ্রহণকারীর ন্যায় আচরণ করবেন না। আপনি নিজগুণে আমাদের প্রতি সদয় হোন। আমরা পাপ ও অনিষ্টতার কারণে- যা আমাদের প্রাপ্য সে অনুযায়ী শাস্তি দিবেন না। হে পরিপূর্ণ দয়া ও উদারতার মালিক, হে মহামহিম ও সম্মানের অধিকারী।



🔉🔉 ।।। প্রথম খুৎবা ।।।🔊🔊


الحمد لله رب الأرض والسماء، الوهاب للنعماء، يكشف البأساء والضراء، ويرفع البلاء، ذو الرحمة الواسعة والحكمة البالغة، لربي الحمد والشكر على آلائه كلها ما علمنا منها وما لم نعلم، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، سميع الدعاء، وأشهد أن نبينا وسيدنا محمدا عبده ورسوله صاحب الحمد واللواء، اللهم صلِّ وسلم وبارك على عبدك ورسولك محمد وعلى آله وصحبه الأتقياء.

অতঃপর:


আপনারা সৎকর্ম ও নাজাতের উসিলা হয় এমন আমল করার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’য়ালাকে ভয় করুন। আর যাবতীয় ঈমান বিধ্বংসী ও সকল হারাম উপকরণ পরিহার করুন। কেননা যেব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে তিনি তাকে রক্ষা করেন, আর যে আল্লাহর অবাধ্য হয় ও তাঁর বিধানের লঙ্ঘন করে তাকে তিনি ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত করেন।


হে মানবজাতি!


আপনারা লক্ষ্য করছেন যে পৃথিবীবাসীর উপর দুর্যোগ নেমে এসেছে ও তারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছেন যে, এটা মানুষকে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত করছে ও দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এবং তা খুবই ভায়াবহ। এই ভাইরাসটি যেকোনো বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে তা মানবসভ্যতাকে হুমকি দিচ্ছে, অথচ আমাদের রব পরম করুণাময় ও দয়ালু।


তিনি ইচ্ছা করলে করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ মহামারী রোগ দিতে পারেন। আল্লাহর কৃপায় গুটিকয়েক ছাড়া মানবজাতি আল্লাহর অবাধ্য, সীমালঙ্ঘন ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: 

[ আর আল্লাহ্ মানুষদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করলে, ভূ-পৃষ্ঠে কোনো প্রাণীকেই তিনি রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের নির্দিষ্ট সময় এসে যাবে, তখন তো আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা। ]


তিনি আরো বলেন: 

[ আর তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তোমাদের হাত যা অর্জন করেছে তার কারণে এবং অনেক অপরাধই তিনি ক্ষমা করে দেন। ]


হে আমাদের রব! আপনি যেমন অনেক কিছুই ক্ষমা করেন তেমনি বাকী অল্পও মাফ করে দিন। হে আল্লাহ্! আপনিই তো আরশের উপরে আপনার নিজের কাছে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন: ( আমার রহমত আমার ক্রোধকে ছাড়িয়ে গেছে। ) অতএব হে আল্লাহ্! আমাদের সাথে আপনি আপনার দয়া, বদান্যতা, করুণা, ইহসান ও ক্ষমার আচরণ করুন। আমাদের সাথে বদলা ও হিসাব গ্রহণকারীর ন্যায় আচরণ করবেন না। আপনি নিজগুণে [পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল] আমাদের প্রতি সদয় হোন, আমরা -পাপ ও অনিষ্টতার কারণে- যা আমাদের প্রাপ্য সে অনুযায়ী শাস্তি দিবেন না; হে পরিপূর্ণ দয়া ও উদারতার মালিক, হে মহামহিম ও সম্মানের অধিকারী।


ইবনে উমার রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেন: 

( হে মুহাজিরগণ! জেনে রাখ যে, পাঁচটি কর্মের পাঁচটি প্রতিফল: যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে এমন রোগ বালাই দেখা দিবে যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন তাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করবে না, তখন আল্লাহ্ তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ বাধিয়ে দেন। আর যে জাতিই তার সম্পদের যাকাত দেওয়া বন্ধ করবে, সে জাতির উপর আকাশ হতে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণী না থাকত, তাহলে তাদের মাঝে আদৌ বৃষ্টি হত না। আর যে জাতি মাপ ও ওজনে কম দিবে, সে জাতিই দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট ও শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের শিকার হবে। আর যে জাতি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, তাদের উপর আল্লাহ্ তায়ালা তাদের দুশমনকে ক্ষমতাসীন করে দেন যারা তাদের ধন- সম্পদ কুক্ষিগত করবে। )-সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।


হে মানবজাতি!

এটার মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা আপনাদেরকে অনুগ্রহ করতে চান, অতএব আপনারা তাঁকে সন্তুষ্ট করুন। তিনি আপনাদেরকে শিক্ষা, উপদেশ ও সতর্ক করতে চান; অতএব তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলুন। তিনি চান আপনাদের ক্ষমা করতে; ফলে আপনারা যেন তাঁর কাছে তওবা করেন, তাঁর প্রতি বিনয়ী হন এবং তাঁর কাছে দোয়া করেন। কেননা আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালবাসেন, এবং একারণে তাদেরকে মহা প্রতিদান দিবেন।


আল্লাহ তায়ালা বলেন: 

[ আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্য্যশীলদেরকে; যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে: আমরা তো আল্লাহর জন্যই। আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের রব-এর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর তারাই সৎপথে পরিচালিত। ]


যারা বিপদমুহূর্তে উপদেশ গ্রহণ করে না, তওবা করে না ও বিনয়ী হয় না তাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা ভর্ৎসনা করেছেন ও শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। এমর্মে তিনি বলেন: 

[ আর অবশ্যই আপনার আগে আমরা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি; অতঃপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পাকড়াও করেছি, যাতে তারা অনুনয়-বিনয় করে। সুতরাং যখন আমাদের শাস্তি তাদের উপর আপতিত হল, তখন তারা কেন বিনীত হল না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল। ]

আল্লাহ্ তায়ালা আরো বলেন: 

[ তারা কি দেখে না যে, তাদেরকে প্রতি বছর একবার বা দুবার বিপর্যস্ত করা হয়? এরপরও তারা তওবা করে না এবং উপদেশ গ্রহণ করে না? ]


তিনি আরো বলেন: 

[ আর আমরা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, তারপরও তারা তাদের রবের প্রতি অবনত হল না এবং কাতর প্রার্থনাও করল না। ]


হে মানবসকল!


পূর্ব যুগের মানুষ ও প্রজন্মের অবস্থার কথা চিন্তা করে দেখুন, বিভিন্ন অপরাধের কারণে আল্লাহ্ তায়ালা কীভাবে তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন! অথচ তাদের মধ্যে কেউ কেউ নবীদের সন্তানও ছিল! পূর্ব যুগের মানুষদেরকে আল্লাহ্ তায়ালা যেসকল পাপের কারণে ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো এযুগেও ব্যাপকহারে বর্তমান রয়েছে এবং তা অবিরত বেড়েই চলেছে।

আর আল্লাহ্ তায়ালার শ্বাশত বিধানগুলো মুমীন ও কাফের সকলের ওপরই বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ বলেন: 

[ তোমাদের মধ্যকার কাফেররা কি তাদের চেয়ে ভাল? নাকি তোমাদের অব্যাহতির কোনো সনদ রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবে? ] 

তিনি আরো বলেন: 

[ এটাও কি তাদেরকে হেদায়াত করল না যে, আমরা তাদের পূর্বে ধ্বংস করেছি বহু প্রজন্মকে- যাদের বাসভূমিতে তারা বিচরণ করে থাকে? নিশ্চয়ই এতে প্রচুর নিদর্শন রয়েছে; তবুও কি তারা শুনবে না? ]


হে মানবজাতি!


এমন কোনো দানবীর ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যিনি পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ই দেয়ার ক্ষমতা রাখেন, তিনি যদি বিশাল বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাসকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, আসবাবপত্র, চিকিৎসা, বস্ত্র ইত্যাদি সবকিছুর ব্যবস্থা করে মানুষদেরকে সাময়িকভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়ে বলেন: তোমরা এ বাড়িতে শর্তাবলী ও নিয়মকানুন মেনে থাকতে থাক; যারা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শর্তাবলী মেনে বসবাস করতে পারবে, তাদেরকে এর চেয়ে বহুগুণ উত্তম বাড়িতে স্থানান্তরিত করব। আর যারা শর্তভঙ্গ করে ও নিয়ম না মেনে থাকবে, ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশৃংখলা, অন্যায় ও অশ্লীলতা করে বেড়াবে, তাদেরকে অনিষ্টকর, কষ্টদায়ক এক বাড়িতে স্থানান্তর করব; আপনারা কি মনে করেন না যে এটা ঐ বাড়িওয়ালার করুণা ও ইনসাফের অন্তর্ভূক্ত? হ্যাঁ অবশ্যই।


আর আল্লাহ্ তায়ালার জন্যই ভূমণ্ড ও নভোমণ্ডলের সর্বোত্তম উদাহারণ! সেই অস্থায়ী বাড়িটি হল দুনিয়া, আর পরবর্তী বাড়ি হচ্ছে জান্নাত বা জাহান্নাম। আল্লাহই আমাদের জন্য আসমান তৈরি করেছেন, জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছেন, সমুদ্র ও নদ-নালাকে অনুগত করেছেন এবং সকল উপকারী বস্তুকে অধীনস্ত করে দিয়েছেন। আর এ সবকিছুর উপর আদম সন্তানদের কর্তৃত্ব দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: 

[ আর আসমানকে আমরা নির্মাণ করেছি আমাদের ক্ষমতা বলে এবং আমরা নিশ্চয়ই মহাসম্প্রসারণকারী। আর জমিনকে আমরা বিছিয়ে দিয়েছি, অতঃপর আমরা কত সুন্দর ব্যবস্থাপনাকারী। ]

তিনি আরো বলেন: 

[ আল্লাহ্, যিনি সাগরকে তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন, যেন তাঁর আদেশে তাতে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে। আর যেন তোমরা তাঁর অনুগ্রহ তালাশ করতে পার এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আর তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও জমিনের সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে। নিশ্চয়ই এতে অনেক নিদর্শনাবলী রয়েছে, এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে। ]

তিনি আরো বলেন: 

[ এবং তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীসমূহকে। ]

তিনি আরো বলেন: 

[ তোমাদেরকে সৃষ্টি করা কঠিন, না আসমান সৃষ্টি? তিনিই তা নির্মাণ করেছেন; তিনি এর ছাদকে সুউচ্চ করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন। আর তিনি এর রাতকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং প্রকাশ করেছেন এর সূর্যালোক; আর জমিনকে এর পর বিস্তৃত করেছেন। তিনি তা থেকে বের করেছেন তার পানি ও তৃণভূমি, আর পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করেছেন; এসব তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুগুলোর ভোগের জন্য। অতঃপর যখন মহাসংকট উপস্থিত হবে, মানুষ যা করেছে তা সে সেদিন স্মরণ করবে, আর প্রকাশ করা হবে জাহান্নামকে দর্শকদের জন্য। সুতরাং যে সীমালংঘন করে, এবং দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়; জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাস। ]


আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের উপর তাঁর নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করেছেন; যেন আমরা তাঁরই ইবাদত করি, তাঁর সাথে কোন অংশীদার স্থাপন না করি এবং কিতাব ও সুন্নাত মোতাবেক আমল করি। এতেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের নিশ্চয়তা এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতি হতে সুরক্ষা। আল্লাহ্ বলেন: 

[ এভাবেই তিনি তোমাদের ওপর তাঁর নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করেছেন, যেন তোমরা আত্মসমর্পন কর।]


হে মানবজাতি!


বালা মসিবত আপতিত হয় পাপের কারণে, আর তা উঠিয়ে নেয়া হয় তওবার মাধ্যমে। মানুষকে যে ভাইরাস আক্রান্ত করেছে, তা থেকে বাঁচতে বেশি বেশি দোয়া করুন এবং শরীয়তসম্মত উপকরণগুলো মেনে চলুন। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার পাশাপাশি সতর্কতাবলম্বন করা এবং স্বাস্থ্যগত দিকনির্দেশনা মেনে চলার মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করুন। দেশবাসি ও প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদেমুল হারামাইন শরীফাইনের বক্তব্যে যে আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, সেই সাথে তার নেতৃত্বে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন করছে সেজন্যও কৃতজ্ঞতা জানাই।


যাবতীয় বিপদাপদ হতে সুরক্ষার জন্য আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলই হচ্ছে একমাত্র ঠিকানা ও ঢাল। সেই সাথে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণও শরীয়ত ও বিবেক নির্দেশিত। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধুই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার উপরই নির্ভর করল, সে যেন আল্লাহর সাথে শিরক করল। আর যে ব্যক্তি সতর্কতা অবলম্বন করল না সে যেন শরীয়ত ও বিবেক উভয়কেই অস্বীকার করল। তবে এই বিপদকে আল্লাহ্ তায়ালা অচিরেই দূরীভূত করবেন ইনশা-আল্লাহ্।


আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: 

[ আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে। ]


ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেন: 

( জেনে রাখ যে, কষ্টের সাথে মুক্তির উপায়ও রয়েছে ) -মুস্তাদরাক হাকেম।


আল্লাহর বান্দাগণ!


আপনারা আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদিরে পূর্ণ বিশ্বাসী হোন, কেননা তাকদিরের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের ছয়টি রুকনের অন্যতম। এটার অর্থ হচ্ছে: এই মর্মে জ্ঞান রাখা ও পূর্ণ বিশ্বাস করা যে, এই পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই ঘটে না এবং আল্লাহই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ্ বলেন: 

[ আমি প্রত্যেক বস্তুই সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। ] 

অতএব ভাগ্যের ভাল মন্দের উপর ঈমান আনা আবশ্যক। আর আমাদের রব আমাদের সংবাদ দিয়েছেন যেকোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নেই। তিনি বলেন: 

[ তিনি গায়েব সম্পর্কে সম্যক অবগত; আসমানসমূহে ও জমিনে তাঁর অগোচরে নয় অণু পরিমান কিছু কিংবা তার চেয়ে ছোট বা বড় কিছু; এর প্রত্যেকটিই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে। ]


তিনি আরো বলেন: 

[ তিনি প্রত্যেকটি বস্তু গণনা করে হিসেব রেখেছেন। ] 

একমাত্র আমাদের রবই জানেন যা কিছু ঘটেছে, যা কিছু ঘটবে এবং যা কিছু ঘটবার নয়। আর যদি কিছু ঘটে তবে তা কীভাবে ঘটবে সেটাও তিনিই জানেন। যেমন তিনি বলেন: 

[ আপনি যদি দেখতে পেতেন যখন তাদেরকে আগুনের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবে, হায়! যদি আমাদেরকে ফেরত পাঠানো হত, আর আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ না করতাম এবং আমরা মুমীনদের অন্তর্ভূক্ত হতাম। বরং আগে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আর তাদের আবার (দুনিয়ায়) ফেরত পাঠানো হলে, তাদেরকে যা করতে নিষেধ করা হয়েছিল আবার তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী। ]


তাকদিরের ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহর জ্ঞান ও সেবিষয় লিপিবদ্ধ থাকার উপর। আল্লাহর নির্ধারিত বিষয়গুলো হিকমত ও তাৎপর্যপূর্ণ। তা কিঞ্চিত পরিমাণই প্রকাশ পায়। রহস্য ও উপকারবিহীন কোনো অকল্যাণ আল্লাহ্ তা’য়ালা সৃষ্টি করেন না। করোনা ভাইরাস আপতিত হওয়ার অন্যতম হিকমত হচ্ছে: মানুষ যেন স্মরণ করে যে, ইতোপূর্বে তারা কত প্রশান্তি ও তৃপ্তির সাথে রাতে দিনে ইবাদত ও অন্যান্য কাজে সহজে চলাচল করতে পারত! তারা যেন সুস্থতা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করে এবং অন্যায় থেকে ফিরে এসে তওবা করে।


এমন দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে: সৃষ্টির কাছে আল্লাহর সম্মান, তার অপরিসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে প্রকাশ করা; যেন সন্দিহান ব্যক্তির পূর্ণ বিশ্বাস আসে। কেননা এই ভাইরাস খালি চোখে দেখা যায় না, অথচ তা মানবজাতিকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে! মানুষের পাপের কারণে আল্লাহ্ তায়ালা যদি এর চেয়েও শক্তিশালী কিছু চাপিয়ে দেন তাহলে কী অবস্থা হবে? তিনি তো বলেন: 

[ তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ কিছুই জানে না। ]


সমকালীন এই দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে: একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহর সামনে মানুষের দুর্বলতা ও অক্ষমতার শিক্ষা লাভ করা। মানুষের কৃতকর্মের কারণে আল্লাহ যদি তাঁর সূক্ষ্ম কোন সৃষ্টি তাদের উপর চাপিয়ে দেন, তারা তা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে না। আল্লাহ্ বলেন: 

[ আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ্ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোন অভিভাবক নেই। ]


হে মানুষ! আপনি কি জানেন না যে, আপনি পিপীলিকার চেয়েও দুর্বল? কেননা পিপীলিকার দেহের অর্ধেক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও সে বেঁচে থাকে, আর মানুষের ক্ষুদ্র অঙ্গহানী হলেও সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

এরকম দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে: আল্লাহ্ তায়ালা এমন লঘু শাস্তি দিয়ে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন মহা শাস্তির কথা; যেন তারা তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ বলেন: 

[ আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে মহা শাস্তির পূর্বে কিছু লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে। ] 

আল্লাহই তাঁর সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু।


এই দুর্যোগের অন্যতম হিকমত হচ্ছে: সন্দেহ পোষণকারীদের নিকটে এই মর্মে প্রমাণাদি প্রকাশিত হওয়া যে, বিশ্ব প্রভু আল্লাহই এককভাবে সৃষ্টিজগতকে পরিচালনা করেন, তিনি একক, এক্ষেত্রে অণু পরিমানও তাঁর শরীক নেই। আল্লাহ্ বলেন: 

[ তিনি যা ইচ্ছা তা-ই বাস্তবায়ন করেন। ]


এই ভাইরাস যদি এমনিতেই নিজ ইচ্ছা ও ক্ষমতাবলে এক ব্যক্তি হতে অপর ব্যক্তির কাছে পৌঁছত, তাহলে সকল মানবজাতিকেই বা অধিকাংশকেই আক্রান্ত করত! বরং তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আক্রান্ত করছেন, যাকে ইচ্ছে তা থেকে রেহাই দিচ্ছেন; সবই তাঁর ইনসাফ ও অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত।


তাওহীদের শিক্ষায় রাসূল সাঃ নিম্নের হাদিসে এমনটিই সাব্যস্ত করেছেন: 

( রোগের কোনো সংক্রমণ নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, আর সফর মাসের কোনো অশুভ নেই। ) বুখারী ও মুসলিমের হাদিসটি আবু হুরাইরা রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে।


রোগের সংক্রমণকে অস্বীকারের বিষয়ে হাদিসটির ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক আলেমগণ বলেন: আল্লাহ্ ইচ্ছে না করলে কোনো রোগ নিজে নিজেই এক ব্যক্তি হতে অপর ব্যক্তিকে সংক্রমিত করতে পারে না এবং আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া রোগ স্বভাবত এমনি এমনি ছড়ায় না। আল্লাহ না চাইলে রোগীর সংস্পর্শে থাকলেও সে রোগ ব্যক্তিকে সংক্রমণ করতে পারে না। ফলে উক্ত হাদিসে ( রোগের কোনো সংক্রমণ নেই ) বলতে জাহেলী যুগের মানুষের বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে; যেখানে তারা ধারণা করত যে, রোগ-ব্যাধি আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়াই স্বভাবত নিজে নিজেই সংক্রমণ করে। আর একজন মুসলিমকে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করার পাশাপাশি সতর্কতামূলক শরীয়তসম্মত উপকরণ ও বৈধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল সাঃ বলেন: 

( তুমি কুষ্ঠ রোগী হতে সেভাবে পালাও যেভাবে সিংহের ভয়ে পালাও। ) সহীহ বুখারীতে হাদিসটি আবু হুরাইরা রাঃ হতে বর্ণিত হয়েছে।


সাহাবীদের যুগেও প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। সে সময় উমর রাঃ সিরিয়ায় আগমণ করেননি। আবু উবায়দা রাঃ সহ আরো অনেক সাহাবা সেখানে সেই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমর বিন আস রাঃ সিরিয়ায় জনগণকে মহামারী রোগের কারণে পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বলেন, অবশেষে তাকে আল্লাহ্ তায়ালা সেই রোগে তুলে নেন।


এই রোগকেও আল্লাহ্ তায়ালা অচিরেই উঠিয়ে নিবেন ইন-শা-আল্লাহ্। একজন মুসলিমের উচিত এমন সময়ে আতঙ্ক, ভয় ও উদ্বেগ পরিহার করে চলা।


অতএব আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলই বান্দাকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করে এবং দেহ-মনে শক্তি যোগায়। পক্ষান্তরে ভয়, আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণে সবকিছুতে শরীরে অস্থিরতা অনুভব হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আর তাওহীদেই রয়েছে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা।


হে মানবসকল!


আপনারা এই দুর্যোগকে স্বাগত জানান বেশি বেশি দোয়া করার মাধ্যমে এবং সকল অন্যায় অশ্লীলতা ও তা প্রকাশ করা হতে তওবা করার মাধ্যমে। কেননা প্রকাশ্যে পাপকর্ম করাই সকল অনিষ্টতা ও দুনিয়ায় গজবের কারণ। মানুষের সাথে সেরকম আচরণ করুন যেমনটি আপনি তাদের কাছ থেকে আশা করেন, কোনো ব্যাপারেই কেউ যেন কারো প্রতি অবিচার না করে। বর্তমানে মানুষের প্রতি মানুষের জুলুম নির্যাতন এতই সীমালংঘন করেছে যে তা পর্বতমালাও সহ্য করতে পারবে না। জুলুমের শাস্তি অধিকাংশ সময় খাসভাবে জালিম ব্যক্তির উপরই আসে, তবে ক্ষেত্রবিশেষ কখনো কখনো তা সর্বসাধারনের উপরও আপতিত হয়।


বেশি বেশি দান সদকা করুন, কেননা এর মাধ্যমে বালা মসিবত দূর হয়। বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করুন, কেননা যিকিরেই রয়েছে পথ্য, চিকিৎসা ও বিভিন্ন রোগের সুরক্ষা। সকাল সন্ধ্যার যিকিরগুলো নিয়মিত পাঠ করুন, এক্ষেত্রে যিকির সম্পর্কে কিতাব সংগ্রহ করুন। যিকির সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব হল: তুহফাতুয যাকিরীন। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন: 

[ আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ কর তোমাদের কাছে শাস্তি আসার আগে; তার পরে তোমাদের সাহায্য করা হবে না। ]

بارك الله لي ولكم في القرآن العظيم.


🔊🔊 ।।। দ্বিতীয় খুৎবা ।।।🔊


الحمد لله رب العالمين، الرحمن الرحيم، مالك يوم الدين، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له القوي المتين. وأشهد أن نبينا وسيدنا محمدا عبده ورسوله الأمين، اللهم صلِّ وسلم وبارك على عبدك ورسولك محمد وعلى آله وصحبه والتابعين.

অতঃপর:


আপনারা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করুন, তবেই শুভ পরিণাম পেয়ে সফল ও বিজয়ী হবেন এবং সকল অনিষ্টতা ও ধ্বংস হতে নাজাত পাবেন। মুত্তাকীরাই বিজয়ী হয়েছেন আর কাফেররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন: 

[ জমিনে বা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয়ই আসে তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই আমরা তা কিতাবে লিপিবদ্ধ রেখেছি। নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষে এটা খুব সহজ। এটা এ জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন তার জন্য আনন্দিত না হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না কোনো উদ্ধত- অহংকারীদেরকে। ]


ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেন: 

( জেনে রাখ, যা তোমার কাছ থেকে এড়িয়ে গেছে, তা তোমাকে আক্রান্ত করার ছিল না। আর যা তোমাকে আক্রান্ত করেছে, তা তোমার কাছ থেকে এড়িয়ে যাওয়ার ছিল না। ) মুস্তাদরাক হাকেম। 

এর ব্যাখ্যা হচ্ছে: আল্লাহ্ তায়ালা যা আপনার তাকদীরে রাখেননি তা মোটেও আপনাকে স্পর্শ করবে না। আর যা তিনি আপনার ভাগ্যে রেখেছেন তা আপনাকে স্পর্শ করবেই। হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, শুধু সতর্ক থাকলেই তাকদীরের ফয়সালা থেকে বাঁচা যাবে না। বরং আগত ও অনাগত সকল দুর্যোগে আল্লাহর কাছে দোয়া করাই বেশি উপকারী।


আল্লাহর বান্দাগণ: 

[ নিশ্চয় আল্লাহ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোয়া-ইস্তিগফার করেন। হে ইমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর দরুদ পাঠ কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। ]

Thursday, January 2, 2020

January 02, 2020

মেয়েদের পর্দা বিষয়ক ১৫ টি হাদিস..



1⃣দেবর মৃত্যু সমতুল্য। (মৃত্যু থেকে মানুষ যেভাবে পলায়ন বা সতর্কতা অবলম্বন করে এক্ষেত্রে তাই করতে হবে) (বুখারীঃ ৫২৩২, মুসলিমঃ ২১৭২, তিরমিযীঃ ১১৭১)
2⃣কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে নির্জনে মিলিত হলে নিঃসন্দেহে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান। (তিরমিযীঃ ১১৭১)
3⃣তোমরা সেই মহিলাদের নিকট গমন করো না যাদের স্বামীরা বিদেশে আছে। কারণ, শয়তান তোমাদের রক্ত শিরায় প্রবাহিত হয়। (তিরমিযীঃ ১১৭২)
4⃣কোন অবৈধ নারীকে স্পর্শ করার চেয়ে মাথায় লোহার পেরেক পুঁতে যাওয়া ভালো। (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহঃ ২২৬)
5⃣রাসূল (সঃ) বলেন, “দুই শ্রেণীর মানুষ জাহান্নামের অধিবাসী যাদেরকে আমি দেখিনি। তারা ভবিষ্যতে আসবে। প্রথম শ্রেণী হবে একদল অত্যাচারী, যাদের সঙ্গে থাকবে গরুর লেজের মত চাবুক যার দ্বারা তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণী হল সে নারীর দল, যারা কাপড় পরিধান করবে কিন্তু তবুও তারা উলঙ্গ অবস্থায় থাকবে, নিজেরা অন্যদের প্রতি আকৃষ্ট এবং অন্যদেরকেও তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে, যাদের মস্তক (খোঁপা বাধার কারণে) উটের হেলে যাওয়া কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তার গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ বহু দূরবর্তী স্থান থেকেও পাওয়া যাবে।” (মুসলিমঃ ২১২৮)
6⃣রাসূল (সঃ) মসজিদের বাহিরে দেখতে পান যে, নারীরা রাস্তায় পুরুষের সাথে মিশে গেছেন। তখন আল্লাহর রাসূল (সঃ) নারীদের বলেন, তোমরা অপেক্ষা কর, কারণ, তোমাদের জন্য রাস্তার মাঝে হাটা উচিত নয়, তোমাদের জন্য হল রাস্তার পাশ। এ কথা শোনে নারী দেয়াল ঘেঁসে হাটা শুরু করে তখন দেখা গেল তাদের অনেকের কাপড় দেয়ালের সাথে মিশে যেত। (আবু দাউদঃ ৫২৭২)
7⃣কোন মহিলা যেন মাহরাম পুরুষ ছাড়া একাকিনী সফর না করে, তার নিকট যেন মাহরাম ছাড়া কোনো বেগানা পুরুষ প্রবেশ না করে, এ কথা শোনে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমি অমুক অমুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য সৈন্য দলে নাম লিখিয়েছি অথচ আমার স্ত্রী হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন এখন আমি কি করব? রাসূল (সঃ) তাকে উত্তর দিলেন তুমি তার সাথে বের হও। (বুখারীঃ ১৮৬২)
8⃣নারী গুপ্ত জিনিস, সুতরাং যখন সে(বাড়ি হতে) বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের দৃষ্টিতে রমণীয় করে দেখায়। (তিরমিযীঃ ১১৩৭)
9⃣রাসূল (সঃ) আমাদেরকে নিষেধ করেছেন যে, “আমরা যেন মহিলাদের নিকট তাদের স্বামীদের বিনা অনুমতিতে গমন না করি।” (তিরমিযীঃ ২৭৭৯)
🔟প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচারী। আর নারী যদি সুগন্ধি ব্যবহার করে কোনো (পুরুষের) মজলিসের পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় তাহলে সে এক বেশ্যা। এমন কি এই অবস্থায় নামাযের জন্য যেতেও নিষিদ্ধ। রাসূল (সঃ) বলেন, “যে মহিলা সেন্ট ব্যবহার করে মসজিদে যায়, সেই মহিলার গোসল না করা পর্যন্ত কোনো নামায কবুল হবে না।” (সহীহ আল-জামে আস-সগীর আযযিয়াদাতুহঃ ২৭০)
1⃣1⃣আদম সন্তানের উপর ব্যভিচারের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছে সে অবশ্যই তার মধ্যে লিপ্ত হবে। দুই চোখের ব্যভিচার হল দৃষ্টি, দুই কানের ব্যভিচার হল শ্রবণ, মুখের ব্যাভিচার হল কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হল স্পর্শ করা এবং পায়ের ব্যভিচার হল খারাপ উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়া। আর অন্তর আশা ও আকাঙ্ক্ষা করতে থাকে। লজ্জা স্থান তাকে বাস্তবায়ন করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। (মুসলিমঃ ২৬৫৭)
1⃣2⃣যে নারী স্বগৃহ, স্বামীগৃহ বা মায়ের বাড়ি ছাড়া অন্য স্থানে নিজের পর্দা রাখে (কাপড় খোলে) সে তার ও তার রবের মধ্যকার পর্দা ও লজ্জাশীলতাকে বিদীর্ণ করে দেয়। (তিরমিযীঃ ২৮০৩)
1⃣3⃣কোন নারীর উপর তোমার দৃষ্টি পড়লে তার প্রতি) বারবার দৃষ্টিপাত করো না। বরং নজর অতিসত্তর ফিরিয়ে নিও, কারণ, তোমার জন্য প্রথমবার ক্ষমা, দ্বিতীয়বার নয়। (আহমদঃ ১৩৬৯)
1⃣4⃣নারীদের বেশ ধারী পুরুষের উপর অভিশাপ এবং পুরুষদের বেশ ধারিণী নারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। (ইবনে মাজাহঃ ১৯০৪)
1⃣5⃣যে নারী তার মাথায় এমন চুল বাড়তি লাগায় যা তার মাথার নয়, সে তার মাথায় জালিয়াতি সংযোগ করে। (সহীহ আল-জামিউস সাগীরঃ ২৭০৫)
লেখাটি ভালো লাগলে এবং উপকৃত হলে শেয়ার করে পৌঁছিয়ে দিন অন্যের কাছে।
কেননা রাসূল (সাঃ) বলেছেন,“যে ব্যক্তি মানুষকে হিদায়াতের দিকে ডাকে তার জন্য ঠিক ঐ পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে, যে পরিমাণ পাবে তাকে অনুসরণকারীরা।” [সহীহ মুসলিম/২৬৭৪,৬৮০৪]

January 02, 2020

পর্দা না করার ভয়াবহ পরিণামঃ

১৯৮৬ সালে করাচীর “দৈনিক জং” পত্রিকায় এক দুঃখিনী মায়ের লেখা একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল।
.
সেই চিঠিতে মহিলা লিখেছেন, আমার বড় মেয়ে কিছুদিন আগে মারা গেছে। তাকে কবর দেওয়ার জন্য কবর খনন করা হলে দেখা গেল, পঞ্চাশ ষাটটি সাপ কবরে কিলবিল করছে। এ অবস্থা দেখে দ্বিতীয় তারপর তৃতীয় জায়গায় কবর খনন করা হলো। যেখানেই কবর খনন করা হচ্ছিলো সেখানেই ওসব সাপ দেখা যাচ্ছিলো।
.
পরামর্শ করে আত্বীয়-স্বজন সেই সাপের উপরেই আমার মেয়ের লাশ রেখে মাটি চাপা দিয়ে ঘরে ফিরে এলো। মেয়েকে কবর দিয়ে ঘরে ফিরার পর মেয়েটির পিতা আমার স্বামী মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন আর কাঁদতে লাগলেন।
.
আমার দুঃখিনী মেয়েটি নামাজ রোজা নিয়মিত আদায় করতো কিন্তু তার দোষ ছিল একটাই, সে ছিল অত্যন্ত ফ্যাশনপ্রিয়। সব সময় সেজে থাকতো। ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় উগ্র সাজগোজ করতো। আমি নিষেধ করলে আমাকে অপমান করতো। মুখে যা আসে তাই বলতো। আমার কোন কথাই সে শুনতো না।
.
কবরে মেয়ে উলঙ্গ অবস্থায় ধনুকের মত বেঁকে আছেঃ
.
১৪১৪ হিজরীর শাবান মাসের শেষ শুক্রবার। আমার এক বন্ধু করাচীর কুরুঙ্গি এলাকার একটি ঘটনা আমাকে জানালো। সে শপথ করে বললো, আমি যা বলছি একটি শব্দও মিথ্যা নয়।
.
আমার এক আত্নীয়ের যুবতী মেয়ে হঠাৎ মারা গেল। সে মেয়েটিকে কবর দেওয়ার সময় কবরে তার পিতাও নেমেছিলেন। ঘরে ফেরার পর পিতার মনে পড়লো, তার হ্যান্ডব্যাগ কবরে রয়ে গেছে। ব্যাগে জরুরি কাগজপত্র থাকায় পুণরায় কবর খনন করা হল। উপরের মাটি সরিয়ে একখানা তক্তা সরিয়ে ভিতরে তাকিয়ে মেয়েটির পিতা চিৎকার দিয়ে দূরে সরে এলেন।
.
কি হয়েছে? কি দেখলেন? চিৎকার দিচ্ছেন কেন? এসব কথার জবাবে মেয়েটির পিতা জানালো, সাদা ধবধবে কাফনে জড়িয়ে মেয়েকে কবর দিলাম। তাকিয়ে দেখি গায়ে কাফন নেই। আমার মেয়ে ধনুকের মত বেঁকে আছে, তার মাথার চুল দিয়ে তার দুই পা বাঁধা, ভয়ানক ছোট বিচ্ছুর মত প্রাণী মেয়েটির সারা দেহ লেপটে আছে। এ অবস্থ দেখে মেয়েটির পিতা তার হ্যান্ডব্যাগের কথা ভুলে গেলেন, তাড়াতাড়ি মাটি চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরে এলেন।
.
মেয়েটির জীবন যাপন সম্পর্কে আমি খোঁজ নিলাম। মেয়েটির মা বাবা বললো, তার মধ্যে আপত্তিকর কোন দোষ আমাদের চোখে ধরা পড়ে নাই। তবে অন্য মেয়েদের মত ছিল সে ফ্যাশনপ্রিয়। ফ্যাশনেবল ছিল তার চালচলন। সে কখনও পর্দা করেনি। বেপর্দা অবস্থায় চলাফেরা করতো। কয়েকদিন আগে উগ্র সাজে সেজে এক আত্নীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠনে যোগদান করেছিল।

Friday, September 27, 2019

September 27, 2019

রাসুল (সা:) এর শরীরে চাটাইয়ের বিচানার দাগ দেখে হযরত ওমর (রা:) এর অনুভূতি


ঘরের দুয়ারের নিকট নীরবে বসে আছেন হযরত ওমর (রা:) । মনটা খুব বিষন্ন। তাঁর অতীত জীবন তাঁকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। কত না ভুল করেছেন তার অতীত জীবনে। কত পাপ করেছেন জেনে, না জেনে। অগ্নি পূজা করেছেন, পাথরের মূর্তির পূজা করেছেন, মদ্য পান করেছেন। এমন কি রাসূল (সা.) কে হত্যা করতে ও উদ্দত হয়েছেন।
ওমর (রা.) আকাশের পানে তাকালেন।ঝকঝকে আকাশ।সাদা-নীল মেঘ গুলো আকাশে খেলা করছে।কিন্তু এই সুন্দর আকাশ তার মনকে দুলায়িত করতে পারছে না। তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অনুশোচনার মেঘ অশ্রু মাটিতে পড়ছে। আল্লাহ কি মাফ করবেন সেই পাপ, সেই ভুল গুলো। নিশ্চয় করবেন।তিনি তো রহমান।
তার বিবি জয়নব (রা:) পিছনেই দাড়িয়ে আছেন। তাকে একটা কথা জানানো দরকার। কিন্তু তার সাথে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না। কিভাবে বলবেন সমস্যার কথা, বিপদের কথা। স্বয়ং মুশরিক দলের নেতা আবু জাহেল, আবু লাহাবের মত ক্ষমতাবান মানুষ পর্যন্ত তাকে ভয় পান। কিন্তু কথাটা না বললেই নয়। তিনি অবশেষে বলেই ফেললেন, - হযরত একটা কথা ছিল।ওমর রা. চমকে উঠলেন হঠাৎ তাঁর বিবির কথার আওয়াজ পেয়ে। তিনি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলেন। কিন্তু স্ত্রীর দিকে ঘুরে বসলেন না। তিনি চান না তার স্ত্রী তার বিষন্ন অবস্থাটা দেখুক।আকাশ পানে তাকিয়ে থেকেই বললেন,
-বল, কি কথা।
-আসলে ঘরে গতকাল থেকে কোন কোন খাবার নেই। গত রাতে সন্তানদের গল্প বলে, ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম পারিয়েছি। কিন্তু আজ কি বলব!
ওমর রা. ভুলেই গিয়েছিলেন গতকাল রাতে তিনি না খেয়েছিলেন। এশার নামাজ পড়ে, বাসায় এসে সামান্য ঘুমিয়ে সারা রাত ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। রাতভর ইস্তেগফর করেছেন। রাত গড়িয়ে সকাল হয়েছে। সকালের খাবারও এখনও খাওয়া হয়নি!! তার ঘরের মানুষরা ও না খেয়ে আছেন??!! তিনি বিবি কে পাল্টা প্রশ্ন করলেন - ঘরে কোন খাবারি নেই?
-না। গতকাল সামান্য যতটুকু জব ছিল সেটা দিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু আজ কি করব?
আমরা হয়ত না খেয়ে দিন পার করতে পারব কিন্তু সন্তানরা তো পারবে না। ওরা ছোট, অবুঝ। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা ওদের নেই।ওদের জন্য হলেও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করুন।
ওমর (রা:) কপালে চিন্তার নতুন ভাঁজ পড়ল।দারিদ্রতার ভাঁজ। তাঁকে বাজারে যেতে হবে। কাজ জোগার করতে হবে। খাবার কিনতে হবে।
তিনি উঠলেন। ভাবলেন বাজারে যাওয়া আগে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে যাবেন। তার পবিত্র মুখ খানা দেখে অনুশোচনার জ্বালা কিছুটা কমিয়ে নিবেন।এসব ভাবতে ভাবতে ওমর রা. রাসুল (সা:) বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
ওমর (রা:) সালাম দিয়ে, রাসুল (সা:) কামরায় প্রবেশ করতেই দেখলেন, এক জীর্ণ চাটাইয়ের ওপর রাসূল (সা:) নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে আছেন। দারিদ্রতা চাটাইয়ের পার্শ্ব গিলে ফেলেছে। চাটাই টি খেজুর গাছের শক্ত পাতা দিয়ে তৈরী। রাসুল (সা:) শরীরের এক পাশে চাটাইয়ের খেজুরের শক্ত পাতার দাগ পড়ে গেছে, সামান্য গর্তের মত সৃষ্টি হয়েছে।
মাথার নীচে খেজুরের ছাল-ভর্তি বালিশ। মাথার উপর ছিল রোদে না শুকানো চামড়া। ঘরের এক কোণে সল্প পরিমাণ যব পড়ে আছে।তার পাশে পর্দার নিচে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কিছু ঘাস।
রাসুল (সা:) এ অবস্থা দেখে ওমর (রা:) তার দারিদ্রের কথা ভুলে গেলেন। তিনি অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলেন।
ওমর রা. এক ফোটা চোখের পানি রাসুল (সা:) পায়ে পড়তেই, উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলতেই দেখেন ওমর (রা:) চোখে পানি। ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছেন। রাসুল (সা) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-হে ওমর কিসে তোমাকে এক দুঃখ দিল। কিসের জন্যে তোমার চোখে পানি?
ওমর (রা:) ভারী গলায় বললেন, হে আল্লাহর প্রিয় নবী! কেন আমি কাঁদবো না। এ চাটাই আপনার পবিত্র শরীরে চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। সামান্য যব, চাটাই এই হল আপনার সম্পদ, যা দেখেছি তা ছাড়া আর কিছুই নেই। অথচ কায়সার ও কইরা কাফিররা স্বর্নের সিংহাসন, রেশম বিছানা, ফল-ফলাদি ও ঝর্ণাধারার মাঝে বসবাস করে। আর আপনি আল্লাহর নবী! আল্লাহর প্রিয় পাত্র! আপনার এ কি অবস্থা! দয়ার নবী রাসূল (সা:) মৃদু হেসে বলেন, তারা ঐ শ্রেণীর লোক যাদের কে ভোগ-বিলাস অগ্রিম দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। আর আমরা হলাম ঐ শ্রেণীর লোক যাদেরকে আখেরাতে নায-নেয়ামত দেয়া হবে। কিন্তু সেই নায-নেয়ামত কখনও ফুরিয়ে যাবে না। তুমি কি চাও না আমাদের জন্য হোক সেই আখেরাত। তাদের জন্য হোক এই দুনিয়া।
ওমরা রা. এই কথা শুনে আনন্দে তার চোখ ঝলমল করতে লাগল। খুশিতে তার অনুশোচনা, দু:খ, কান্না দূর হয়ে গেল। ওমর (রা:)বলেন, হ্যা। আখেরাতই আমাদের ভোগ-বিলাস আনন্দের জায়গা, সেটাই আমাদের চিরস্থ্য়ী আল্লাহর অসীম নেয়ামত ভোগ করার জায়গা।
হযরত মুহাম্মদ (সা:) ও ওমর (রা:) এর কথা শুনে আনন্দে হেসে দিলেন এবং বললেন, বুদ্ধমানরা মাত্রই এভাবে ভেবে থাকে।
হাদীস, ইবনে হিব্বান-৪১৮৮, আহমদ-১/৩
September 27, 2019

মাদরাসা বন্ধ হবে না হয়তো নিজের রিজিক বন্ধ হয়ে যাবে


দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসায় একজন উস্তাদ দরস দিচ্ছেন,
হঠাৎ কী মনে করে নীরব হয়ে গেলেন,
ছাত্ররা লক্ষ করল উস্তাদের চোখ দিয়ে টপ টপ
করে মুক্তোর মতো পানি পড়ছে, অবাক
বিস্ময়ে ছাত্ররা জিজ্ঞেস করলো, হুজুর!
আপনি কাঁদছেন কেনো?
জবাবে উস্তাদ বললেন!
এই এলাকার জমিদার
বৃটিশের মনসন্তুষ্টির জন্য তার অধীনস্থ কৃষকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে!
যদি কোনো কৃষক দেওবন্দ মাদরাসায় চাঁদা দেয়, তবে তাকে তার জমি চাষ করতে দিবে না। কৃষকরা জমি হাতছাড়া হয়ে যাবার
ভয়ে মাদরাসায় চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে!
প্রত্যুত্তরে ছাত্ররা বলে, হুজুর! এ জন্য
আপনি কাঁদছেন কেনো?
বৃটিশের গোলাম ওই জমিদারের অধীনস্থ কৃষকরা যদি আমাদের মাদরাসায়
চাঁদা না দেয়, তবে কি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাবে?
আমরা হজরত বেলাল (রাঃ)র রুহানি আওলাদ, প্রয়োজনে না-খেয়ে থাকব, অনশনে মরব, তবুও নবীজির লাঠির দাগে -দাগে যেই
মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হয়েছে তা থেকে অধ্যয়ন বন্ধ
করবনা !উস্তাদ বললেন, মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাবে, এই দুঃখে আমি কাঁদছি না।
বরং যে জমিদার বৃটিশের ধোঁকায় পড়ে মাদরাসায় চাঁদা দেয়া বন্ধ করেছে,
আকাশ থেকে মহান আল্লাহ কি তার রিজেক বন্ধ করে দেন!
আমি সেই দুঃখে কাঁদছি!
এর বেশ কিছু দিন পর দেখা গেলো, একটা ভিক্ষুক প্রতিদিন দেওবন্দ মাদরাসায় এসে ছাত্রদের কাছে খাবার তালাশ করে, ছাত্ররা কিছু
দিলে নিয়ে নেয়, না-দিলে ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির
হয়ে ছাত্রদের অহেতুক গালি গালাজ করে।
ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করলে একজন উস্তাদ বলেন, এই ফকিরের পূর্ব পুরুষ জমিদার ছিল, সেই জমিদার যেদিন থেকে হুমকি দিয়ে কৃষকদের চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দেয়, সে দিন থেকে আল্লাহ তায়ালা তার রিজিক বন্ধ করে দেন, এই ভিক্ষুক হচ্ছে সেই জমিদার বংশের বেঁচে থাকা শেষ সন্তান, যে আজ ভিক্ষার থলি নিয়ে দুয়ারে -দুয়ারে ঘুরছে।
অতএব, আজো যারা ভাবছেন, মাদরাসায় চাঁদা না-
দিয়ে মাদরাসা বন্ধ করে দিবেন,
তারা জেনে রাখুন!
মাদরাসা বন্ধ হবে না,
আপনি নিজেই বন্ধ হয়ে যাবেন, কেননা এ-
মাদরাসাগুলো কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
September 27, 2019

বিশ্বনবীর ঘরে ইহুদি মেহমান


মদিনার এক সন্ধ্যায় বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো আযানের সুর। মিনারের আল্লাহু ধ্বনি খেজুরের পাতা ভেদ করে পৌঁছে গেল অলিতে গলিতে। সাহাবিরা মসজিদে। সেজদা-তাসবিহ ও তেলাওয়াতে মগ্ন। নবী মুহাম্মদও তখন মসজিদে। নবীর দরবারে এসে পৌঁছাল একদল মুসাফির। সন্ধ্যার এই অবেলায় নবীজি মুসাফিরদের মেহমানদারির আয়োজন করলেন। সাহাবিদের বললেন, যাও মেহমানদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করো, ওরা আমাদের অতিথি। রাসুল নিজেও একজন অতিথি ঘরে নিয়ে গেলেন।
আরবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেসময় পাপের গন্ধ। পথিক মানেই ভয়-আতঙ্ক। লুটেরা-ডাকাত। সব ডর-ভয় উপেক্ষা করে দয়াল নবী অচেনা অজানা মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। রাসুল সা.-এর ঘরে সেই অতিথি ছিলো ইহুদি। জেনে শুনেও নবীজি তাকে নিজ হাতে খাওয়ালেন। ইহুদি বলে কথা। মুহাম্মদকে বিপদে ফেলতে না পারলে আবার কেমন ইহুদি। সে মনে মনে ইচ্ছা করলো, ‘আজ আমি ঘরের সব খাবার একাই খাবো।’ ভাবনা ও কাজে মিলে গেল। একেবারে পেট পুরে খেলেন। নবীজি নিজেই তার বিছানা করলেন। ইহুদি মেহমান গা এলিয়ে দিলেন ঘুমের বিছানায়। গভীর রাত। নীরব নিস্তদ্ধ। ঘুম ভেঙে গেল অতিথির। একেতো মরু পথের দীর্ঘ ক্লান্তি, আবার খেয়েছেও গলা পর্যন্ত। এবার পেটে প্রচণ্ড চাপ। কিন্তু এতো রাতে, অজানা অচেনা জায়গায় কোথায় যাবে?
এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বিছানা নষ্ট করে ফেলেছে আগন্তুক। এবার ভয় পেয়ে গেল ইহুদি, মুহাম্মদ সা. মদিনার সম্রাট। তার ঘরে এমন অপকর্ম! লোকটি ভয়ে পালিয়ে গেলো। ছুটে পালাচ্ছে সে যেদিকে দু’চোখ যায়। যদি মুহাম্মদের লোকেরা তাকে ধরে ফেলে এমন ভয়ে ছুটছে প্রাণপণে। এমনি সময় তার মনে হলো সে তলোয়ার ফেলে এসেছে মুহাম্মদের ঘরে।
সে সময় তলোয়ার ছাড়া ভ্রমণ কল্পনাই করা যায় না। কি করবে আগন্তুক? সিদ্ধান্ত নিলো আবার মদিনায় যাবে, তলোয়ার ছাড়া একমুহুর্তও অসম্ভব। চুপিচুপি মুহাম্মদ সা.-এর ঘরে এসে ঢুকেছে ইহুদি। মনে বড় ভয়! কি জানি কি হয়!
আরে! এ কি! কী দেখছে সে? ইহুদি মেহমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। রাসুল সা. নিজের হাতের লোকটির নষ্ট করে যাওয়া বিছানা ধুয়ে দিচ্ছেন। চেহারায় রাগের চিহ্ন নেই।
রাসুল সা. তাকে দেখে ছুটে এসেছেন তার কাছে। তাকে বলতে লাগলেন- ও ভাই! আমার ভুল হয়ে গেছে, রাতে তোমার খোঁজ নিতে পারিনি, আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট করেছো। আমাকে মাফ করে দাও! ইহুদি ভাবতেও পারছে না এমনটা। মানুষ বুঝি এমন হয়। তাও রক্ত মাংসে গড়া মানুষ! মানবিক মানুষের উপমা। ইহুদি মেহমান এবার মাথা নুইয়ে দিলেন নবীজির কাছে। সমকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন- ‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ ওগো আল্লাহর নবী, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি; আল্লাহ এক-আপনি আল্লাহর রাসুল।
September 27, 2019

হযরত খিযির (আঃ) ও হযরত মুসা (আঃ) এর ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা


হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, হযরত উবাই ইবনু কাব (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:) হতে আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মুসা (আঃ) একদা বনী ইসরাঈলের এক সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল , কোন ব্যক্তি সর্বাধিক জ্ঞানী ? তিনি বললেন, আমিই সর্বাধিক জ্ঞানী(যেহেতু তিনি আল্লাহর নবী ছিলেন)। জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ না করার কারণে আল্লাহ্ তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বরং দু’সাগরের সঙ্গমস্থলে আমার এক বান্দা আছে, যিনি তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী।
হযরত মূসা (আঃ) বললেন, হে আমার প্রতিপালক! তার নিকট পৌঁছাতে কে আমাকে সাহায্য করবে? কখনো সুফইয়ান এভাবে বর্ণনা করেছেন, আমি কিভাবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারি? তখন বলা হল, তুমি একটি থলিতে করে একটি মাছ নাও। যেখানে তুমি মাছটি হারাবে, সেখানেই আমার সে বান্দা আছে। অতঃপর হযরত মুসা (আঃ) একটি মাছ ধরলেন এবং থলিতে রাখলেন। অতঃপর মাছ নিয়ে তাঁর সঙ্গী হযরত ইউশা বিন নূনকে সাথে নিয়ে চললেন। শেষ পর্যন্ত তারা একটি পাথরের কাছে পৌঁছলেন এবং তার উপর মাথা রেখে বিশ্রাম নিলেন। মুসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। এ সময় মাছটি থলি থেকে বের হয়ে লাফিয়ে সমুদ্রে চলে গেল। অতঃপর সে সমুদ্রে সুড়ঙ্গের মত পথ করে নিল।আর আল্লাহ্‌ মাছটির চলার পথে পানির প্রবাহ থামিয়ে দিলেন।ফলে তার গমন পথটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল।অতঃপর তারা উভয়ে অবশিষ্ট রাত এবং পুরো দিন সেই পথে চললেন।
পরদিন সকালে হযরত মূসা (আঃ) তার সাথীকে বললেন, আমরা তো সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আমাদের খাবার নিয়ে এস।হযরত মুসা (আঃ) কে আল্লাহ্‌ যে স্থানে যাবার কথা বলেছিলেন, সেই স্থান অতিক্রম করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোনরূপ ক্লান্তিবোধ করেননি। সাথী ইউশা বিন নুন তখন বলল, আপনি কি ভেবে দেখেছেন, যে পাথরটির নিকট আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেখানেই মাছটি অদ্ভুত ভাবে সমুদ্রের মধ্যে চলে গেছে। কিন্তু আমি মাছটির কথা আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। মূলত: শয়তানই আমাকে এ কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, পথটি মাছের জন্য ছিল একটি সুড়ঙ্গের মত আর তাঁদের জন্য ছিল আশ্চর্যজনক ব্যাপার।
হযরত মুসা (আঃ) বললেন, আমরা তো সেই স্থানটিরই অনুসন্ধান করছি। অতঃপর তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললেন এবং ঐ পাথরের নিকটে পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি কাপড় মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মুসা (আঃ) তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, এখানে সালাম কি করে এলো? তিনি বললেন, আমি মূসা। খিযির (আ:) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনী ইসরাঈল বংশীয় মূসা? মূসা (আঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি এসেছি এজন্য যে, সত্য পথের যে জ্ঞান আল্লাহ আপনাকে দান করা হয়েছে, তা হতে আপনি আমাকে শিক্ষা দিবেন। খিযির (আ:) বললেন, হে মূসা! আমার আল্লাহ্‌ প্রদত্ত কিছু জ্ঞান আছে, যা আপনি জানেন না। আর আপনিও আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এমন কিছু জ্ঞানের অধিকারী, যা আমি জানি না। মূসা (আঃ) বললেন, আমি কি আপনার সাথী হতে পারি? খিযির (আ:) বললেন, ‘আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। যে বিষয় আপনার জ্ঞানের আওতাধীন নয় সে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করবেন কেমন করে?’ মূসা (আঃ) বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ্‌ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আপনার কোন আদেশ আমি অমান্য করব না’ (কাহফ ৬৭-৬৯) ।
অতঃপর তাঁরা দু’জনে সাগরের কিনারা ধরে হেঁটে চললেন। তখন একটি নৌকা তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদেরকে নৌকায় তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। তারা খিযির (আ:) কে চিনতে পেরে বিনা ভাড়ায় তাঁদেরকে নৌকায় তুলে নিলো। যখন তাঁরা দু’জনে নৌকায় চড়লেন, তখন একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকাটির কিনারায় বসল এবং সমুদ্র থেকে এক ফোঁটা বা দুই ফোঁটা পানি পান করল। খিযির বললেন, ‘হে মুসা! আমার ও আপনার জ্ঞানের দ্বারা আল্লাহ্‌ জ্ঞান হতে ততটুকুও কমেনি যত টুকু এ পাখিটি তাঁর ঠোটের দ্বারা সাগরের পানি হ্রাস করেছে’।
তখন খিযির (আ:) একটি কুড়াল নিয়ে নৌকাটির একটা তক্তা খুলে ফেললেন। মূসা (আঃ) অকস্মাৎ দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেলেন যে, তিনি কুড়াল দিয়ে একটি তক্তা খুলে ফেলেছেন। তখন তিনি তাঁকে বললেন, আপনি একি করলেন? এ লোকেরা বিনা ভাড়ায় আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিলো, আর আপনি তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নৌকা ছিদ্র করে দিলেন? আপনি তো একটি গুরুতর কাজ করলেন। খিযির (আ:) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, আমার ভুলের জন্য আমাকে অপরাধী করবেন না এবং আমার এ ব্যবহারে আমার প্রতি কঠোর হবেন না।মূসা (আঃ)-এর পক্ষ থেকে প্রথম এ কথাটি ছিল ভুলক্রমে।
অতঃপর তাঁরা যখন উভয়ে সমুদ্র পার হলেন, তখন তারা একটি বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে অন্যান্য বালকদের সাথে খেলা করছিল। খিযির (আ:) ছেলেটির মাথা দেহ হতে ছিন্ন করে ফেললেন। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? আপনি খুবই খারাপ একটা কাজ করলেন। খিযির (আ:) বললেন, আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করতে পারবেন না। মূসা (আঃ) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোন প্রশ্ন করি, তাহলে আমাকে আর সঙ্গে রাখবেন না। অতঃপর উভয়ে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে তাঁরা একটি জনপদের অধিবাসীদের নিকট পৌঁছে তাদের নিকট কিছু খাবার চাইলেন। কিন্তু জনপদ বাসী তাদের দু’জনের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল।সেখানে তারা একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন, যা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল।হযরত খিযির প্রাচীরটি মেরামত করে সুদৃঢ় করে দিলেন। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, এই বসতির লোকদের নিকট এসে আমরা খাবার চাইলাম।তারা মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। অথচ আপনি এদের দেয়াল সোজা করে দিলেন। আপনি তো ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। হযরত খিযির (আ:) বললেন, এবার আমার এবং আপনার মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেল।এক্ষণে যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, আমি এর তাৎপর্য বলে দিচ্ছি।
নৌকাটির ব্যাপার ছিল এই যে, সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির।তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত।আমি নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিতে চাইলাম। কারণ, তাদের সামনে ছিল এক রাজা, যে ভাল নৌকা পেলেই জোরপূর্বক কেড়ে নিত। তারপর যখন এটাকে দখল করতে লোক আসল, তখন ছিদ্রযুক্ত দেখে ছেড়ে দিল। অতঃপর নৌকাওয়ালারা একটা কাঠ দ্বারা নৌকাটি মেরামত করে নিলো।
আর বালকটি সূচনা লগ্নেই ছিল কাফের। আর সে ছিল তার ঈমানদার বাবা- মার বড়ই আদরের সন্তান। আমি আশঙ্কা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্যতা ও কুফরি দ্বারা তাদেরকে কষ্ট দিবে। অতঃপর আমি ইচ্ছা করলাম যে, তাদের পালনকর্তা তাদেরকে তার চেয়ে পবিত্রতায় ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুন।
আর প্রাচীরের ব্যাপার এই যে, সেটি ছিল নগরের দু’জন ইয়াতীম বালকের। এর নীচে ছিল তাদের গুপ্তধন। তাদের পিতা ছিলেন সৎকর্ম পরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াপরবেশ হয়ে ইচ্ছা পোষণ করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করে নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ ইচ্ছায় এসব করিনি। আপনি যে বিষয়গুলোতে ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, এই হল তার ব্যাখ্যা ।
(কাহফ ৭৯-৮২; ছহীহ বুখারী হা/৩৪০১ ‘নবীদের কাহিনী’অধ্যায়, ‘খিযিরের সাথে মূসা (আঃ)-এর কাহিনী’অনুচ্ছেদ, মুসলিম হা/২৩৮০, ‘ফাযায়েল’অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৬)।
শিক্ষা:
১. সকল জ্ঞানের আধার আল্লাহ্‌ রাববুল আলামীন। তিনি যাকে যতটকু ইচ্ছা প্রদান করেন।
২. জ্ঞান অর্জনের জন্য সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. শয়তান সর্বদা মানুষের পিছে পড়ে থাকে। সে তাকে প্রতিনিয়িত আল্লাহ্‌ বিমুখ করার চেষ্টা করে।
৪. জ্ঞান অর্জনের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করা জরুরী।
৫. অহংকার করা বা নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী ভাবা ঠিক নয়।
September 27, 2019

ইমাম গাজ্জালীর শিক্ষণীয় গল্প


এক ব্যক্তি জঙ্গলে হাটছিলেন। হঠাৎ দেখলেন এক সিংহ তার পিছু নিয়েছে। তিনি প্রাণভয়ে দৌড়াতে লাগলেন।কিছুদূর গিয়ে একটি পানিহীন কুয়া দেখতে পেলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে দিলেন ঝাঁপ। পড়তে পড়তে তিনি একটি ঝুলন্ত দড়ি দেখে তা খপ করে ধরে ফেললেন এবং ঐ অবস্থায় ঝুলে রইলেন।
উপরে চেয়ে দেখলেন কুয়ার মুখে সিংহটি তাকে খাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
নিচে চেয়ে দেখলেন বিশাল এক সাপ তার নিচে নামার অপেক্ষায় চেয়ে আছে। বিপদের উপর আরো বিপদ হিসেবে দেখতে পেলেন একটি সাদা
আর একটি কালো ইঁদুর তার দড়িটি কামড়ে ছিড়ে ফেলতে চাইছে।এমন হিমশিম অবস্থায় কি করবেন যখন তিনি বুঝতে পারছিলেন না, তখন হঠাৎ তার সামনে কুয়ার সাথে লাগোয়া
গাছে একটা মৌচাক দেখতে পেলেন।তিনি কি মনে করে সেই মৌচাকের মধুতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা চেটে দেখলেন। সেই মধুর মিষ্টতা এতই বেশি ছিল যে তিনি কিছু মুহূর্তের জন্য উপরের গর্জনরত সিংহ, নিচের হাঁ করে থাকা সাপ, আর দড়ি কাঁটা ইঁদুরদের কথা ভূলে
গেলেন। ফলে তার বিপদ অবিশ্যম্ভাবী হয়ে
দাঁড়ালো।
ইমাম গাজ্জালী এই গল্পের ব্যাখ্যা
দিতে গিয়ে বলেন :
¤ এই সিংহটি হচ্ছে আমাদের মৃত্যু,যে
সর্বক্ষণ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
¤ সেই সাপটি হচ্ছে কবর। যা আমাদের
অপেক্ষায় আছে।
¤ দড়িটি হচ্ছে আমাদের জীবন, যাকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকা।
¤ সাদা ইঁদুর হল দিন, আর কালো ইঁদুর হল রাত, যারা প্রতিনিয়ত ধীরে ধীরে
আমাদের জীবনের আয়ু কমিয়ে দিয়ে আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর
¤ সেই মৌচাক হল দুনিয়া। যার সামান্য মিষ্টতা পরখ করে দেখতে গেলেও আমাদের এই চতুর্মুখি ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়াটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে।
হে আল্লাহ আপনি আমাদের দুনিয়াবি গজব থেকে হেফাজাত করেন।
September 27, 2019

সত্য বলায় শহীদ হলেন তাবেয়ী সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.)


উমাইয়া শাসনামলে ইরাকে এক অত্যাচারী শাসক ছিলেন। নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তিনি ছিলেন নির্মম প্রকৃতির মানুষ। জুলুম-অত্যাচারের জন্য তার ছিল জগৎজোড়া পরিচিতি। প্রজারা তার ভয়ে সবসময় কম্পমান থাকতো। কখন যে কোন ভুলের জন্য কার গর্দান যাবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তবে শাসন পরিচালনায় তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি ‘আরবদের নিরো' হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তার নৃশংসতা ও বর্বরতার ইতিহাসও কম নয়। তিনি কারণে-অকারণে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার লোককে হত্যা করেন বলে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি হাজ্জাজ আলেম ও সাহাবীদের সাথেও কঠোর ও বর্বর আচরণ করেছেন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কারো সমালোচনা ও প্রতিবাদ মোটেও সহ্য করতেন না। তার অত্যাচারের কেউ প্রতিবাদ করেছে তো তার আর রেহাই ছিল না। এজন্য ইউসুফের শাসনামলে অনেক আলেমকে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে। তখনকার সময় একজন বিখ্যাত তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর নাম সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সীমাহীন জুলুম ও অত্যাচার তাঁর মোটেও সহ্য হলো না। তাই তিনি প্রতিবাদ করলেন। রুখে দাঁড়ালেন অত্যাচারী শাসকের কঠোরতার বিরুদ্ধে। হযরত জোবায়ের (রা.)-এর সাহস দেখে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠলেন। তবে ইউসুফ জোবায়ের (রা.)কে বন্দী করতে পারলেন না। শেষমেশ মক্কার শাসনকর্তা জোবায়ের (রা.)কে গ্রেফতার করে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শাসনকর্তা তাবেয়ীকে সামনে পেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। তার বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। রাগে-ক্ষোভে হাজ্জাজ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাদশাহ ইউসুফ বন্দীর দিকে ক্ষীপ্রতার সাথে চোখ তুলে তাকালেন। তিনি বন্দীকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম শুনে তাঁকে ও তাঁর মাকে ব্যঙ্গ করে কথা বললেন।
জোবায়ের (রা.) তো মুমিন বান্দা। তিনি জুলুমবাজ সরকারের হুমকিকে পরোয়া করেন না। বন্দীর দৃঢ়তা দেখে হাজ্জাজ বন্দীকে হত্যা করার ভয় দেখালেন।
হাজ্জাজ বললেন, ‘তুমি দেখছি খুবই সাহস দেখাচ্ছো। দেখ, আমি তোমাকে এখনই মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে দিচ্ছি'। কিন্তু জোবায়ের (রা.) বললেন,
‘শুনুন আমাদের শাসক! আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আর আপনি শুনে রাখুন, যে জেনেশুনে কোন মুমিনকে হত্যা করে তার পুরস্কার জাহান্নাম। আপনি আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছেন। আজ আপনি যেভাবে আমাকে হত্যা করছেন, আখিরাতে ঠিক তেমনিভাবে আমিও আপনাকে হত্যা করবো।'
হযরত জোবায়েরের কথায় হাজ্জাজ আরও ক্ষিপ্ত হলেন। তার চোখেমুখে বিরক্তি ও ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি বন্দীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আরে বোকা বন্দী, রাখ তোর এসব কথা। এবার বল, তোকে কিভাবে হত্যা করবো?'
বন্দী সাঈদ বললেন, ‘আপনার যা পছন্দ আপনি সেটাই করবেন, এতে আমার কোন পছন্দ বা অপছন্দ নেই।'
এবার হাজ্জাজ বললেন, ‘আমি যদি তোকে ক্ষমা করে দেই, তা হলে কেমন হয়?'
হযরত সাঈদ (রা.) বললেন, ‘হে বাদশাহ‘‘ আমাকে ক্ষমা করা বা হত্যা করার অধিকার আপনার হাতে নেই। আমার প্রভু আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে আপনার কোন কিছু করারই এখতিয়ার নেই। আমাকে হত্যা করেন তো আমি শহীদের মর্যাদা পাবো, আর ছেড়ে দেন তো আমি গাজী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবো। দু'টোই আমার জন্য পরম ভাগ্যের ব্যাপার। আমার হারাবার কিছুই নেই।'
বন্দী সাঈদের কথা শাসক হাজ্জাজের সহ্য হলো না। তিনি প্রচন্ড রেগে গিয়ে জল্লাদকে কাছে ডাকলেন এবং বন্দীকে হত্যা করার হুকুম দিলেন।
জল্লাদ বন্দীকে নিয়ে চললো হত্যা করার জন্য। জল্লাদকে দেখে সাঈদ (রা.) মুচকি হাসলেন।
বন্দীর হাসি দেখে জল্লাদ অবাক হলো। বন্দীকে হত্যা করা হবে, অথচ সে কিনা হাসছে! এ রকম কান্ড জল্লাদ আর দেখেনি। এটা তার কাছে রহস্য বলে মনে হলো। তাই জল্লাদ বন্দীকে আবার বাদশাহর দরবারে ফিরিয়ে নিলো এবং বাদশাহকে সবকিছু খুলে বললো। বাদশাহ হাজ্জাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বন্দী, তুই হাসলি কেন?'
বন্দী সাঈদ বললেন, ‘আমি হাসলাম একজন মুমিনকে হত্যা করার মতো আপনার দুঃসাহস দেখে। আরও এজন্য যে, তোমার ওপর প্রতিশোধ না নিতে আল্লাহতায়ালার ধৈর্য দেখে।'
বন্দীর কথা হাজ্জাজকে আরেকবার উত্তেজিত ও রাগান্বিত করে তুললো।
হাজ্জাজ এবার জল্লাদকে নির্দেশ দিলেন, ‘নিয়ে যাও একে। তাড়াতাড়ি বন্দীর গর্দান উড়িয়ে দাও।'
কোন ভীতি নেই সাঈদ (রা.)-এর মধ্যে। তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন। এবার কিবলার দিকে মুখ করে শান্তভাবে উচ্চারণ করলেন, ‘আমি ঐ পাকজগতের দিকে মুখ করলাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আমি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরই দিকে মনোনিবেশ করলাম। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।'
হযরত সাঈদের এই কাজও হাজ্জাজের পছন্দ হলো না। তিনি জল্লাদকে বললেন, ‘ওর মুখ কিবলার দিক থেকে সরিয়ে নাসারাদের কিবলার দিকে করে দাও।'
একথা শুনে সাঈদ (রা.) বললেন, ‘তোমরা আমার মুখ যেদিকেই ঘুরাও, আল্লাহতায়ালা সেদিকেই আছেন।'
সাঈদ (রা.)-এর এই সত্য বাণীও বাদশাহ হাজ্জাজের সহ্য হলো না। তিনি বললেন, ‘হে জল্লাদ! এখনই বন্দীকে হত্যা করেন, আর দেরি নয়।'
তারপর জল্লাদ তার কাজ শেষ করলো। হযরত সাঈদ (রা.)কে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা হযরত সাঈদ (রা.) শহীদ হলেন। কিন্তু অত্যাচারী শাসক হাজ্জাজের কাছে মাথা নত করলেন না। অন্যায় ও অসত্যের বিপরীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন তাবেয়ী হযরত সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.)।
September 27, 2019

ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল_উখদূদের_কাহিনী


বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদকুর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হলে একদিন সে রাজাকে বলল,আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব।
বাদশাহ তার নিকট একটি বালক কে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। বালকটি তার নিকট বসল এবং তার কথা শুনে মুগ্ধ হল। বালকটি যাদুকরের নিকট যাওয়ার সময় ঐ সন্ন্যাসীর নিকট বসে তাঁর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌঁছাতে বালকটির দেরী হত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে, তুমি যদি যাদুকর কে ভয় কর তাহলে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব করেছে এবং বাড়ীর লোকজনকে ভয় পেলে বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।
বালকটি এভাবে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন পথে সে দেখল,একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে, যাদুকর শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ? অতঃপর সে একটি প্রস্তর খন্ড নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্‌! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেল, যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’।
এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে প্রস্তরখন্ডটি ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটি ঐ প্রস্তাঘাতে মারা গেল এবং লোক চলাচল শুরু হল।
এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহলে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না। বালকটির দোআয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হতে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হতে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হতেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকন সহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, তুমি যদি আমাকে চক্ষুষ্মান করে দাও, তাহলে এ সবই তোমার। বালকটি বলল, আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং রোগ ভাল করেন আল্লাহ্‌। অতএব আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহলে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দোআ করতে পারি। তাতে তিনি হয়ত আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন। ফলে লোকটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করলেন।
পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল। অতঃপর বালকটিকে রাজ দরবারে আনা হল। রাজা তাকে বললেন, বৎস! আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠোব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হল, তুমি তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হলে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হল।
তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছাবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহলে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুড়ে ফেলে দিবে। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হল’? তখন সে বলল, আল্লাহই আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর।’ তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছালে বালকটি পূর্বের ন্যায় দোআ করল, ‘হে আল্লাহ্‌! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্ত দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহ্‌ই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিসতীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূনীর হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজিত করুন। তারপর (বালকটির রব আল্লাহর নামে) বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন। আপনি যদি এ পন্থা অবলম্বন করেন, তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন।
বালকের কথামত এক বিসতীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা বালকটির তূনীর হতে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হল। বালকটি এক হাতে তীরবিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।
এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তাগুলির চৌমাথায় প্রকান্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হল । তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকমু পালন করতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তাসহ উপস্থিত করা হল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্তত করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন।কেননা আপনি হক পথে আছেন’।
পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে,
‘ধবংস হয়েছিল গর্তওয়ালারা- ইন্ধনপূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারনে যে, তারা বিশ্বাস করতো পরাক্রমশালী ও প্রশংসার্হ আল্লাহে’ (বুরূজ ৪-৮)।
[সহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচেছদ-১৭, শুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।
#শিক্ষা :
-----------------
১. প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
৩. রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহর পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তার ঈমানের মযবূতী পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
September 27, 2019

হযরত আদম (আলাইহিস সালাম)




হযরত আদম (আলাইহিস সালাম)

শয়তানের সৃষ্টি ছিল মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ
আদম সৃষ্টির কাহিনী
খলীফা অর্থ
সিজদার ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য
আদমের পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব
নারী জাতি পুরুষেরই অংশ এবং তার অনুগত
নগ্নতা শয়তানের প্রথম কাজ
মানব সৃষ্টির রহস্য
জান্নাত থেকে পতিত হবার পর
আদমের অবতরণ স্থল
‘আহদে আলাস্ত্ত-র বিবরণ
‘আহদে আলাস্ত্ত-র উদ্দেশ্য
অন্যান্য অঙ্গীকার গ্রহণ
আদমের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব
দুনিয়াবী ব্যবস্থাপনায় আদম (আঃ)
আদম পুত্রদ্বয়ের কাহিনী
হত্যাকান্ডের কারণ
শিক্ষণীয় বিষয়
মৃত্যু ও বয়স
আদম (আঃ)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ





১. হযরত আদম (আলাইহিস সালাম)


বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হিসাবে আল্লাহ পাক আদম (আলাইহিস সালাম)-কে নিজ দু’হাত দ্বারা সরাসরি সৃষ্টি করেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। মাটির সকল উপাদানের সার-নির্যাস একত্রিত করে আঠালো ও পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মাটির তৈরী সুন্দরতম অবয়বে রূহ ফুঁকে দিয়ে আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন।[1]


অতঃপর আদমের পাঁজর থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেন।[2] আর এ কারণেই স্ত্রী জাতি স্বভাবগত ভাবেই পুরুষ জাতির অনুগামী ও পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট। অতঃপর স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে একই নিয়মে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কুরআন-এর বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম দিন থেকেই মানুষ পূর্ণ চেতনা ও জ্ঞান সম্পন্ন সভ্য মানুষ হিসাবেই যাত্রারম্ভ করেছে এবং আজও সেভাবেই তা অব্যাহত রয়েছে। অতএব গুহামানব, বন্যমানব, আদিম মানব ইত্যাদি বলে অসভ্য যুগ থেকে সভ্য যুগে মানুষের উত্তরণ ঘটেছে বলে কিছু কিছু ঐতিহাসিক যেসব কথা শুনিয়ে থাকেন, তা অলীক কল্পনা ব্যতীত কিছুই নয়। সূচনা থেকে এযাবত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানুষ কখনোই মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু ছিল না। মানুষ বানর বা উল্লুকের উদ্বর্তিত রূপ বলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) যে ‘বিবর্তনবাদ’ (Theory of Evolution) পেশ করেছেন, তা বর্তমানে একটি মৃত মতবাদ মাত্র এবং তা প্রায় সকল বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।


প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে আল্লাহ সর্ব বিষয়ের জ্ঞান ও যোগ্যতা দান করেন এবং বিশ্বে আল্লাহর খেলাফত পরিচালনার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। সাথে সাথে সকল সৃষ্ট বস্ত্তকে করে দেন মানুষের অনুগত (লোকমান ৩১/২০) ও সবকিছুর উপরে দেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব (ইসরা ১৭/৭০)। আর সেকারণেই জিন-ফিরিশতা সবাইকে মানুষের মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আদমকে সিজদা করার আদেশ দেন। সবাই সে নির্দেশ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইবলীস অহংকার বশে সে নির্দেশ অমান্য করায় চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/৩৪)। অথচ সে ছিল বড় আলেম ও ইবাদতগুযার। সেকারণ জিন জাতির হওয়া সত্ত্বেও সে ফিরিশতাদের সঙ্গে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিল ও তাদের নেতা হয়েছিল।[3] কিন্তু আদমের উচ্চ মর্যাদা দেখে সে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। ফলে অহংকার বশে আদমকে সিজদা না করায় এবং আল্লাহ ভীতি না থাকায় সে আল্লাহর গযবে পতিত হয়। এজন্য জনৈক আরবী কবি বলেন,


لوكان للعلم شرف من دون التقى


لكان أشرف خلق الله إبليسُ


‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,


তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।


শয়তানের সৃষ্টি ছিল মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ :


ইবলীসকে আল্লাহ মানুষের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ সৃষ্টি করেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার হায়াত দীর্ঘ করে দেন। মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করার জন্য ও তাকে ধোঁকা দেওয়াই শয়তানের একমাত্র কাজ। ‘সে মানুষকে বলে কুফরী কর’। কিন্তু যখন সে কুফরী করে, তখন শয়তান বলে ‘আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহ্কে ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬)। অন্যদিকে যুগে যুগে নবী-রাসূল ও কিতাব পাঠিয়ে আল্লাহ মানুষকে সত্য পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখেন (বাক্বারাহ ২/২১৩)। আদম থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত এক লক্ষ চবিবশ হাযার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন[4] এবং বর্তমানে সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের ধারক ও বাহক মুসলিম ওলামায়ে কেরাম শেষনবীর ‘ওয়ারিছ’ হিসাবে[5] আল্লাহ প্রেরিত অহীর বিধান সমূহ বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন (মায়েদাহ ৫/৬৭)। পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংস তথা ক্বিয়ামতের অব্যবহিত কাল পূর্ব পর্যন্ত এই নিয়ম জারি থাকবে। শেষনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পৃথিবীর এমন কোন বস্তি ও ঝুপড়ি ঘরও থাকবে না, যেখানে আল্লাহ ইসলামের বাণী পৌঁছে দেবেন না।[6] এতদসত্ত্বেও অবশেষে পৃথিবীতে যখন ‘আল্লাহ’ বলার মত কোন লোক থাকবে না, অর্থাৎ প্রকৃত তাওহীদের অনুসারী কোন মুমিন বাকী থাকবে না, তখন আল্লাহর হুকুমে প্রলয় ঘনিয়ে আসবে এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।[7] মানুষের দেহগুলি সব মৃত্যুর পরে মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রূহগুলি স্ব স্ব ভাল বা মন্দ আমল অনুযায়ী ‘ইল্লীন’ অথবা ‘সিজ্জীনে’ অবস্থান করবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৭, ১৮)। যা ক্বিয়ামতের পরপরই আল্লাহর হুকুমে স্ব স্ব দেহে পুনঃপ্রবেশ করবে (ফজর ৮৯/২৯) এবং চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের জন্য সকল মানুষ সশরীরে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে নীত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৪-৬)।


মানুষের ঠিকানা হ’ল তিনটি : ১- দারুদ দুনিয়া। অর্থাৎ যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি ২- দারুল বরযখ। অর্থাৎ মৃত্যুর পরে কবরের জগত। ৩- দারুল ক্বারার। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন শেষ বিচার শেষে জান্নাত বা জাহান্নামের চিরস্থায়ী ঠিকানা।


অতএব পৃথিবী হ’ল মানুষের জন্য সাময়িক পরীক্ষাগার মাত্র। জান্নাত থেকে নেমে আসা মানুষ এই পরীক্ষাস্থলে পরীক্ষা শেষে সুন্দর ফল লাভে পুনরায় জান্নাতে ফিরে যাবে, অথবা ব্যর্থকাম হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর সেখানেই হবে তাদের সর্বশেষ যাত্রাবিরতি এবং সেটাই হবে তাদের চূড়ান্ত ও চিরস্থায়ী ঠিকানা। আল্লাহ বলেন, ‘মাটি থেকেই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি। ঐ মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেব। অতঃপর ঐ মাটি থেকেই আমরা তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব’ (ত্বোয়াহা ২০/৫৫)। অতঃপর বিচার শেষে কাফেরদেরকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের দিকে এবং মুত্তাক্বীদের নেওয়া হবে জান্নাতে (যুমার ৩৯/৬৯-৭৩)। এভাবেই সেদিন যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি ভোগ করবে এবং মযলূম তার যথাযথ প্রতিদান পেয়ে ধন্য হবে। সেদিন কারু প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না (বাক্বারাহ ২/২৮১)।


উল্লেখ্য যে, হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫০টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[8]


এক্ষণে আদম সৃষ্টির ঘটনাবলী কুরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার আলোকে সার-সংক্ষেপ আমরা তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।


আদম সৃষ্টির কাহিনী :


আল্লাহ একদা ফেরেশতাদের ডেকে বললেন, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। বল, এ বিষয়ে তোমাদের বক্তব্য কি? তারা (সম্ভবতঃ ইতিপূর্বে সৃষ্ট জিন জাতির তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে) বলল, হে আল্লাহ! আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে আবাদ করতে চান, যারা গিয়ে সেখানে ফাসাদ সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা সর্বদা আপনার হুকুম পালনে এবং আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনায় রত আছি। এখানে ফেরেশতাদের উক্ত বক্তব্য আপত্তির জন্য ছিল না, বরং জানার জন্য ছিল। আল্লাহ বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না (বাক্বারাহ ২/৩০)। অর্থাৎ আল্লাহ চান এ পৃথিবীতে এমন একটা সৃষ্টির আবাদ করতে, যারা হবে জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন এবং নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি ও চিন্তা-গবেষণা সহকারে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে আল্লাহর বিধান সমূহের আনুগত্য করবে ও তাঁর ইবাদত করবে। ফেরেশতাদের মত কেবল হুকুম তামিলকারী জাতি নয়।


খলীফা অর্থ :


এখানে ‘খলীফা’ বা প্রতিনিধি বলে জিনদের পরবর্তী প্রতিনিধি হিসাবে বনু আদমকে বুঝানো হয়েছে, যারা পৃথিবীতে একে অপরের প্রতিনিধি হবে (ইবনু কাছীর)। অথবা এর দ্বারা আদম ও পরবর্তী ন্যায়নিষ্ঠ শাসকদের বুঝানো হয়েছে, যারা জনগণের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও ইনছাফপূর্ণ শাসক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবে। কেননা ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও অন্যায় রক্তপাতকারী ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রতিনিধি নয় (ইবনু জারীর)। তবে প্রথম ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য, যা ফেরেশতাদের জবাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন প্রতিনিধি আপনি সৃষ্টি করবেন, যারা পূর্ববর্তী জিন জাতির মত পৃথিবীতে গিয়ে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাবে। বস্ত্ততঃ ‘জিন জাতির উপর ক্বিয়াস করেই তারা এরূপ কথা বলে থাকতে পারে’ (ইবনু কাছীর)।


অতঃপর আল্লাহ আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। ‘সবকিছুর নাম’ বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোট-বড় সকল সৃষ্টবস্ত্তর ইল্ম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দিয়ে দেওয়া হ’ল।[9] যা দিয়ে সৃষ্টবস্ত্ত সমূহকে আদম ও বনু আদম নিজেদের অনুগত করতে পারে এবং তা থেকে ফায়েদা হাছিল করতে পারে। যদিও আল্লাহর অসীম জ্ঞানরাশির সাথে মানবজাতির সম্মিলিত জ্ঞানের তুলনা মহাসাগরের অথৈ জলরাশির বুক থেকে পাখির ছোঁ মারা এক ফোঁটা পানির সমতুল্য মাত্র।[10] বলা চলে যে, আদমকে দেওয়া সেই যোগ্যতা ও জ্ঞান ভান্ডার যুগে যুগে তাঁর জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী সন্তানদের মাধ্যমে বিতরিত হচ্ছে ও তার দ্বারা জগত সংসার উপকৃত হচ্ছে। আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দেওয়ার পর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন। কুরআনে কেবল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখিত হ’লেও সেখানে জিনদের সদস্য ইবলীসও উপস্থিত ছিল (কাহফ ১৮/৫০)। অর্থাৎ আল্লাহ চেয়েছিলেন, জিন ও ফেরেশতা উভয় সম্প্রদায়ের উপরে আদম-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হৌক এবং বাস্তবে সেটাই হ’ল। তবে যেহেতু ফেরেশতাগণ জিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, সেজন্য কেবল তাদের নাম নেওয়া হয়েছে। আর দুনিয়াতে জিনদের ইতিপূর্বেকার উৎপাত ও অনাচার সম্বন্ধে ফেরেশতারা আগে থেকেই অবহিত ছিল, সেকারণ তারা মানুষ সম্বন্ধেও একইরূপ ধারণা পোষণ করেছিল এবং প্রশ্নের জবাবে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ‘আল্লাহ জিন জাতিকে আগেই সৃষ্টি করেন গনগনে আগুন থেকে’ (হিজর ১৫/২৭)। কিন্তু তারা অবাধ্যতার চূড়ান্ত করে।


আদমকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করার পর আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে ঐসব বস্ত্তর নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তারা তা বলতে পারল না। তখন আল্লাহ আদমকে নির্দেশ দিলেন এবং তিনি সবকিছুর নাম বলে দিলেন। ফলে ফেরেশতারা অকপটে তাদের পরাজয় মেনে নিল এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা করে বলল, হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যতটুকু শিখিয়েছেন, তার বাইরে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিময়’ (বাক্বারাহ ২/৩২)। অতঃপর আল্লাহ তাদের সবাইকে আদমের সম্মুখে সম্মানের সিজদা করতে বললেন। সবাই সিজদা করল, ইবলীস ব্যতীত। সে অস্বীকার করল ও অহংকারে স্ফীত হয়ে প্রত্যাখ্যান করল। ফলে সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল (বাক্বারাহ ২/৩৪)। ইবলীস ঐ সময় নিজের পক্ষে যুক্তি পেশ করে বলল, ‘আমি ওর চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন আর ওকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে’। আল্লাহ বললেন, তুই বের হয়ে যা। তুই অভিশপ্ত, তোর উপরে আমার অভিশাপ রইল পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৬-৭৮; আ‘রাফ ৭/১২)।


সিজদার ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য :


আদমকে সৃষ্টি করার আগেই আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে আদমের প্রতি সিজদা করার কথা বলে দিয়েছিলেন (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/১১)। তাছাড়া কুরআনের বর্ণনা সমূহ থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, আদমকে সিজদা করার জন্য আল্লাহর নির্দেশ ব্যক্তি আদম হিসাবে ছিল না, বরং ভবিষ্যৎ মানব জাতির প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে তাঁর প্রতি সম্মান জানানোর জন্য জিন ও ফিরিশতাদের সিজদা করতে বলা হয়েছিল। এই সিজদা কখনোই আদমের প্রতি ইবাদত পর্যায়ের ছিল না। বরং তা ছিল মানবজাতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ও তাদেরকে সকল কাজে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দানের প্রতীকী ও সম্মান সূচক সিজদা মাত্র।


ওদিকে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হ’লেও ইবলীস কিন্তু আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে অস্বীকার করেনি। বরং আল্লাহ যখন তাকে ‘অভিসম্পাৎ’ করে জান্নাত থেকে চিরদিনের মত বিতাড়িত করলেন, তখন সে আল্লাহ্কে ‘রব’ হিসাবেই সম্বোধন করে প্রার্থনা করল, قَالَ رَبِّ فَأَنظِرْنِي إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ- ‘হে আমার প্রভু! আমাকে আপনি ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিন’ (হিজর ১৫/৩৬, ছোয়াদ ৩৮/৭৯)। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। অতঃপর সে বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তেমনি তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানারূপ সৌন্দর্যে প্রলুব্ধ করব এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দেব। তবে যারা আপনার একনিষ্ঠ বান্দা, তাদের ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৩৪-৪০; ছোয়াদ ৩৮/৭৯-৮৩)। আল্লাহ তাকে বললেন, তুমি নেমে যাও এবং এখান থেকে বেরিয়ে যাও। তুমি নীচুতমদের অন্তর্ভুক্ত। এখানে তোমার অহংকার করার অধিকার নেই’ (আ‘রাফ ৭/১৩)। উল্লেখ্য যে, ইবলীস জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হ’লেও মানুষের রগ-রেশায় ঢুকে ধোঁকা দেওয়ার ও বিভ্রান্ত করার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছিলেন।[11] আর এটা ছিল মানুষের পরীক্ষার জন্য। শয়তানের ধোঁকার বিরুদ্ধে জিততে পারলেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে ধন্য হবে। নইলে ইহকাল ও পরকালে ব্যর্থকাম হবে। মানুষের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদা করা ও ইবলীসের সিজদা না করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে এ বিষয়ে যে, মানুষ যেন প্রতি পদে পদে শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখে।


আদমের পাঁচটি শ্রেষ্ঠত্ব :


(১) আল্লাহ তাকে নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। (২) আল্লাহ নিজে তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭২)। (৩) আল্লাহ তাকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩১)। (৪) তাকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/৩৪)। (৫) আদম একাই মাত্র মাটি থেকে সৃষ্ট। বাকী সবাই পিতা-মাতার মাধ্যমে সৃষ্ট (সাজদাহ ৩২/৭-৯)।


ইবলীসের অভিশপ্ত হওয়ার কারণ ছিল তার ক্বিয়াস। সে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি পেশ করে বলেছিল, ‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কেননা আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দয়ে’ (হিজর ২৯)। মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন বলেন, اول من قاس ابليس ‘প্রথম ক্বিয়াস করেছিল ইবলীস’। হাসান বছরীও অনুরূপ বলেছেন।[12]


নারী জাতি পুরুষেরই অংশ এবং তার অনুগত :


সিজদা অনুষ্ঠানের পর আল্লাহ আদমের জুড়ি হিসাবে তার অবয়ব হ’তে একাংশ নিয়ে অর্থাৎ তার পাঁজর হ’তে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন[13] মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’ এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল ‘হাওয়া’ (কুরতুবী)। অতঃপর তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা দু’জন জান্নাতে বসবাস কর ও সেখান থেকে যা খুশী খেয়ে বেড়াও। তবে সাবধান! এই গাছটির নিকটে যেয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫)। এতে বুঝা যায় যে, ফেরেশতাগণের সিজদা কেবল আদমের জন্য ছিল, হাওয়ার জন্য নয়। দ্বিতীয়তঃ সিজদা অনুষ্ঠানের পরে আদমের অবয়ব থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়, পূর্বে নয়। তিনি পৃথক কোন সৃষ্টি ছিলেন না। এতে পুরুষের প্রতি নারীর অনুগামী হওয়া প্রমাণিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল’ (নিসা ৪/৩৪)। অতঃপর বহিষ্কৃত ইবলীস তার প্রথম টার্গেট হিসাবে আদম ও হাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণার জাল নিক্ষেপ করল। সেমতে সে প্রথমে তাদের খুব আপনজন বনে গেল এবং নানা কথায় তাদের ভুলাতে লাগল। এক পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ যে তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে নিষেধ করেছেন, তার কারণ হ’ল এই যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ ৭/২০)। সে অতঃপর কসম খেয়ে বলল যে, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাংখী’ (ঐ, ২১)। ‘এভাবেই সে আদম ও হাওয়াকে সম্মত করে ফেলল এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে তারা উক্ত নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করল। ফলে সাথে সাথে তাদের গুপ্তাঙ্গ প্রকাশিত হয়ে পড়ল এবং তারা তড়িঘড়ি গাছের পাতা সমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? (ঐ, ২২) তখন তারা অনুতপ্ত হ’য়ে বলল, قَالاَ رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (২৩)। ‘আল্লাহ তখন বললেন, তোমরা (জান্নাত থেকে) নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের অবস্থান হবে পৃথিবীতে এবং সেখানেই তোমরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সম্পদরাজি ভোগ করবে’ (২৪)। তিনি আরও বললেন যে, ‘তোমরা পৃথিবীতেই জীবনযাপন করবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে’ (আ‘রাফ ৭/২০-২৫)।


এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইবলীসের কথায় সর্বপ্রথম হাওয়া প্রতারিত হন। অতঃপর তার মাধ্যমে আদম প্রতারিত হন বলে যে কথা চালু আছে কুরআনে এর কোন সমর্থন নেই। ছহীহ হাদীছেও স্পষ্ট কিছু নেই। এ বিষয়ে তাফসীরে ইবনু জারীরে ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে যে বর্ণনা এসেছে, তা যঈফ।[14] দ্বিতীয়তঃ জান্নাত থেকে অবতরণের নির্দেশ তাদের অপরাধের শাস্তি স্বরূপ ছিলনা। কেননা এটা ছিল তওবা কবুলের পরের ঘটনা। অতএব এটা ছিল হয়তবা তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দানের জন্য। বরং সঠিক কথা এই যে, এটা ছিল আল্লাহর পূর্ব নির্ধারিত ও দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। কেননা জান্নাত হ’ল কর্মফল লাভের স্থান, কর্মের স্থান নয়। তাছাড়া জান্নাতে মানুষের বংশ বৃদ্ধির সুযোগ নেই। এজন্য দুনিয়ায় নামিয়ে দেওয়া যরূরী ছিল।


প্রথম বার আদেশ দানের পরে পুনরায় স্নেহ ও অনুগ্রহ মিশ্রিত আদেশ দিয়ে বললেন, ‘তোমরা সবাই নেমে যাও’। অতঃপর পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হওয়ার (বাক্বারাহ ২/৩০; ফাত্বির ৩৫/৩৯) মহান মর্যাদা প্রদান করে বললেন, ‘তোমাদের নিকটে আমার পক্ষ থেকে হেদায়াত অবতীর্ণ হবে। যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্য কোন ভয় বা চিন্তার কারণ থাকবে না। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করবে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।


উল্লেখ্য যে, নবীগণ ছিলেন নিষ্পাপ এবং হযরত আদম (আঃ) ছিলেন নিঃসন্দেহে নিষ্পাপ। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করেননি। বরং শয়তানের প্ররোচনায় প্রতারিত হয়ে তিনি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ বৃক্ষের নিকটবর্তী হওয়ার নিষেধাজ্ঞার কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন। যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا- ‘অতঃপর আদম ভুলে গেল এবং আমি তার মধ্যে (সংকল্পের) দৃঢ়তা পাইনি’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৫)। তাছাড়া উক্ত ঘটনার সময় তিনি নবী হননি বরং পদস্খলনের ঘটনার পরে আল্লাহ তাকে নবী মনোনীত করে দুনিয়ায় পাঠান ও হেদায়াত প্রদান করেন’ (আ‘রাফ ৭/১২২)।


এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইবলীসের ক্ষেত্রে আল্লাহ বললেন, قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيمٌ- ‘তুমি জান্নাত থেকে বেরিয়ে যাও। নিশ্চয়ই তুমি অভিশপ্ত’ (হিজর ১৫/৩৪; আ‘রাফ ৭/১৮)। অন্যদিকে আদম ও হাওয়ার ক্ষেত্রে বললেন, قُلْنَا اهْبِطُواْ مِنْهَا- ‘ তোমরা নেমে যাও’ (বাক্বারাহ ২/৩৬, ৩৮; আ‘রাফ ৭/২৪)। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইবলীস কখনোই আর জান্নাতে ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু বনু আদমের ঈমানদারগণ পুনরায় ফিরে আসতে পারবে ইনশাআল্লাহ।


নগ্নতা শয়তানের প্রথম কাজ :


মানুষের উপরে শয়তানের প্রথম হামলা ছিল তার দেহ থেকে কাপড় খসিয়ে তাকে উলঙ্গ করে দেওয়া। আজও পৃথিবীতে শয়তানের পদাংক অনুসারী ও ইবলীসের শিখন্ডীদের প্রথম কাজ হ’ল তথাকথিত ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার নামে নারীকে উলঙ্গ করে ঘরের বাইরে আনা ও তার সৌন্দর্য উপভোগ করা। অথচ পৃথিবীর বিগত সভ্যতাগুলি ধ্বংস হয়েছে মূলতঃ নারী ও মদের সহজলভ্যতার কারণেই। অতএব সভ্য-ভদ্র ও আল্লাহভীরু বান্দাদের নিকটে ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয হ’ল স্ব স্ব লজ্জাস্থান আবৃত রাখা ও ইযযত-আবরূর হেফাযত করা। অন্যান্য ফরয সবই এর পরে। নারীর পর্দা কেবল পোষাকে হবে না, বরং তা হবে তার ভিতরে, তার কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে ও চাল-চলনে সর্ব বিষয়ে। পরনারীর প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি ও মিষ্ট কণ্ঠস্বর পরপুরুষের হৃদয়ে অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে। অতএব লজ্জাশীলতাই মুমিন নর-নারীর অঙ্গভূষণ ও পারস্পরিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে একে অপরের থেকে স্ব স্ব দৃষ্টিকে অবনত রাখবে (নূর ২৪/৩০-৩১) এবং পরস্পরে সার্বিক পর্দা বজায় রেখে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকু স্বাভাবিকভাবে সংক্ষেপে বলবে। নারী ও পুরুষ প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও পর্দা বজায় রেখে স্ব স্ব কর্মস্থলে ও কর্মপরিধির মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করবে এবং সংসার ও সমাজের কল্যাণে সাধ্যমত অবদান রাখবে। নেগেটিভ ও পজেটিভ পাশাপাশি বিদ্যুৎবাহী দু’টি ক্যাবলের মাঝে প্লাষ্টিকের আবরণ যেমন পর্দার কাজ করে এবং অপরিহার্য এক্সিডেন্ট ও অগ্নিকান্ড থেকে রক্ষা করে, অনুরূপভাবে পরনারী ও পরপুরুষের মধ্যকার পর্দা উভয়ের মাঝে ঘটিতব্য যেকোন অনাকাংখিত বিষয় থেকে পরস্পরকে হেফাযত করে। অতএব শয়তানের প্ররোচনায় জান্নাতের পবিত্র পরিবেশে আদি পিতা-মাতার জীবনে ঘটিত উক্ত অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা থেকে দুনিয়ার এই পঙ্কিল পরিবেশে বসবাসরত মানব জাতিকে আরও বেশী সতর্ক ও সাবধান থাকা উচিত। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে সেদিকেই হুঁশিয়ার করেছে।


মানব সৃষ্টির রহস্য :


আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّيْ خَالِقٌ بَشَرًا مِّن صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَإٍ مَّسْنُوْنٍ، فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيْهِ مِن رُّوحِيْ فَقَعُوْا لَهُ سَاجِدِيْنَ- ‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদের বললেন, আমি মিশ্রিত পচা কাদার শুকনো মাটি দিয়ে ‘মানুষ’ সৃষ্টি করব। অতঃপর যখন আমি তার অবয়ব পূর্ণভাবে তৈরী করে ফেলব ও তাতে আমি আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদায় পড়ে যাবে’ (হিজর ১৫/২৮-২৯)। অন্যত্র তিনি বলেন, هُوَ الَّذِيْ يُصَوِّرُكُمْ فِي الأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَآءُ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ- (آل عمران ৬)- ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে আকার-আকৃতি দান করেছেন যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি মহা পরাক্রান্ত ও মহা বিজ্ঞানী’ (আলে ইমরান ৩/৬)। তিনি আরও বলেন, يَخْلُقُكُمْ فِيْ بُطُوْنِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِّن بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلاَثٍ- (زمر ৬)- ‘তিনি তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে সৃষ্টি করেন একের পর এক স্তরে তিনটি অন্ধকারাচ্ছন্ন আবরণের মধ্যে’ (যুমার ৩৯/৬)। তিনটি আবরণ হ’ল- পেট, রেহেম বা জরায়ু এবং জরায়ুর ফুল বা গর্ভাধার।


উপরোক্ত আয়াতগুলিতে আদম সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমে মাটি দ্বারা অবয়ব নির্মাণ, অতঃপর তার আকার-আকৃতি গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহে শক্তির আনুপতিক হার নির্ধারণ ও পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এবং সবশেষে তাতে রূহ সঞ্চার করে আদমকে অস্তিত্ব দান। অতঃপর আদমের অবয়ব (পাঁজর) থেকে কিছু অংশ নিয়ে তার জোড়া বা স্ত্রী সৃষ্টি করা। সৃষ্টির সূচনা পর্বের এই কাজগুলি আল্লাহ সরাসরি নিজ হাতে করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)। অতঃপর এই পুরুষ ও নারী স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করে প্রথম যে যমজ সন্তান জন্ম দেয়, তারাই হ’ল মানুষের মাধ্যমে সৃষ্ট পৃথিবীর প্রথম মানব যুগল। তারপর থেকে এযাবত স্বামী-স্ত্রীর মিলনে মানুষের বংশ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।


শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদরাজি, জীবজন্তু ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি হয়েছে মাটি থেকে। আর মাটি সৃষ্টি হয়েছে পানি থেকে। পানিই হ’ল সকল জীবন্ত বস্ত্তর মূল (ফুরক্বান ২৫/৫৪)।


মৃত্তিকাজাত সকল প্রাণীর জীবনের প্রথম ও মূল একক (Unit) হচ্ছে ‘প্রোটোপ্লাজম’ (Protoplasm)। যাকে বলা হয় ‘আদি প্রাণসত্তা’। এ থেকেই সকল প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী একে Bomb shell বলে অভিহিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটির সকল প্রকারের রাসায়নিক উপাদান। মানুষের জীবন বীজে প্রচুর পরিমাণে চারটি উপাদান পাওয়া যায়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন। আর আটটি পাওয়া যায় সাধারণভাবে সমপরিমাণে। সেগুলি হ’ল- ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, সালফার ও আয়রণ। আরও আটটি পদার্থ পাওয়া যায় স্বল্প পরিমাণে। তাহ’ল: সিলিকন, মোলিবডেনাম, ফ্লুরাইন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও যিংক। কিন্তু এই সব উপাদান সংমিশ্রিত করে জীবনের কণা তথা ‘প্রোটোপ্লাজম’ তৈরী করা সম্ভব নয়। জনৈক বিজ্ঞানী দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব মৌল উপাদান সংমিশ্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাতে কোন জীবনের ‘কণা’ পরিলক্ষিত হয়নি। এই সংমিশ্রণ ও তাতে জীবন সঞ্চার আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে।


প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের মাধ্যমে বনু আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমন: মৃত্তিকার সারাংশ তথা প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকীট, জমাট রক্ত, মাংসপিন্ড, অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সবশেষে রূহ সঞ্চারণ (মুমিনূন ২৩/১২-১৪; মুমিন ৪০/৬৭; ফুরক্বান ২৫/৪৪; তারেক্ব ৮৬/৫-৭)। স্বামীর শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে রক্ষিত ডিম্বকোষে প্রবেশ করার পর উভয়ের সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে (দাহর ৭৬/২)। উল্লেখ্য যে, পুরুষের একবার নির্গত লম্ফমান বীর্যে লক্ষ-কোটি শুক্রাণু থাকে। আল্লাহর হুকুমে তন্মধ্যকার একটি মাত্র শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবেশ করে। এই শুক্রকীট পুরুষ ক্রোমোজম Y অথবা স্ত্রী ক্রোমোজম X হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেটি স্ত্রীর ডিম্বের X ক্রোমোজমের সাথে মিলিত হয়, সেভাবেই পুত্র বা কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে আল্লাহর হুকুমে।


মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে এইভাবে দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেড়ে ওঠা প্রথমত: একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি, অতঃপর একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত ও প্রতিভাবান শিশু হিসাবে দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হওয়া কতই না বিষ্ময়কর ব্যাপার। কোন মানুষের পক্ষে এই অনন্য-অকল্পনীয় সৃষ্টিকর্ম আদৌ সম্ভব কী? মাতৃগর্ভের ঐ অন্ধকার গৃহে মানবশিশু সৃষ্টির সেই মহান কারিগর কে? কে সেই মহান আর্কিটেক্ট, যিনি ঐ গোপন কুঠরীতে পিতার ২৩টি ক্রোমোজম ও মাতার ২৩টি ক্রোমোজম একত্রিত করে সংমিশ্রিত বীর্য প্রস্ত্তত করেন? কে সেই মহান শিল্পী, যিনি রক্তপিন্ড আকারের জীবন টুকরাটিকে মাতৃগর্ভে পুষ্ট করেন? অতঃপর ১২০ দিন পরে তাতে রূহ সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত মানব শিশুতে পরিণত করেন এবং পূর্ণ-পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেন (আবাসা ৮০/১৮-২০)। বাপ-মায়ের স্বপ্নের ফসল হিসাবে নয়নের পুত্তলি হিসাবে? মায়ের গর্ভে মানুষ তৈরীর সেই বিষ্ময়কর যন্ত্রের দক্ষ কারিগর ও সেই মহান শিল্পী আর কেউ নন, তিনি আল্লাহ! সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আযীম!!


পুরুষ ও নারীর সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম লাভের তথ্য কুরআনই সর্বপ্রথম উপস্থাপন করেছে (দাহর ৭৬/২)। আধুনিক বিজ্ঞান এ তথ্য জনতে পেরেছে মাত্র গত শতাব্দীতে ১৮৭৫ সালে ও ১৯১২ সালে। তার পূর্বে এরিষ্টটল সহ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল যে, পুরুষের বীর্যের কোন কার্যকারিতা নেই। রাসূলের হাদীছ বিজ্ঞানীদের এই মতকে সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করেছে।[15] কেননা সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সন্তান প্রজননে পুরুষ ও নারী উভয়ের বীর্য সমানভাবে কার্যকর।


উল্লেখ্য যে, মাতৃগর্ভে বীর্য প্রথম ৬ দিন কেবল বুদ্বুদ আকারে থাকে। তারপর জরায়ুতে সম্পর্কিত হয়। তিন মাসের আগে ছেলে বা মেয়ে সন্তান চিহ্নিত হয় না। চার মাস পর রূহ সঞ্চারিত হয়ে বাচ্চা নড়েচড়ে ওঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে। যাতে ভূমিষ্ট হওয়ার পরে মায়ের স্তন চুষতে অসুবিধা না হয়। এ সময় তার কপালে চারটি বস্ত্ত লিখে দেওয়া হয়। তার আজাল (হায়াত), আমল, রিযিক এবং সে ভাগ্যবান না দুর্ভাগা।[16]


এভাবেই জগত সংসারে মানববংশ বৃদ্ধির ধারা এগিয়ে চলেছে। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কেবল আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। একারণেই আল্লাহ অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে গেল প্রকাশ্যে বিতন্ডাকারী’। ‘সে আমাদের সম্পর্কে নানারূপ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে। অথচ সে নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভুলে যায়, আর বলে যে, কে জীবিত করবে এসব হাড়গোড় সমূহকে, যখন সেগুলো পচে গলে যাবে? (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৮)।


জান্নাত থেকে পতিত হবার পর :


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে ইমাম আহমাদ, নাসাঈ ও হাকেম (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, ألست بربكم ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই? বনু আদমের কাছ থেকে এই বহুল প্রসিদ্ধ ‘আহদে আলাস্ত্ত’ বা প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতিটি তখনই নেওয়া হয়, যখন আদম (আঃ)-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর এ প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল না‘মান (وادى نَعْمَانَ) নামক উপত্যকায়, যা পরবর্তীকালে ‘আরাফাত’-এর ময়দান নামে পরিচিত হয়েছে।[17] এর দ্বারা একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, জান্নাত ও জাহান্নামের অবস্থান পৃথিবীর বাইরে অন্যত্র এবং তা সৃষ্ট অবস্থায় তখনও ছিল এখনও আছে। আধুনিক বিজ্ঞান এ পৃথিবী ও সৌরলোকের বাইরে দূরে বহুদূরে অগণিত সৌরলোকের সন্ধান দিয়ে কুরআন ও হাদীছের তথ্যকেই সপ্রমাণ করে দিচ্ছে।


আদমের অবতরণ স্থল :


আদম ও হাওয়াকে আসমানে অবস্থিত জান্নাত থেকে নামিয়ে দুনিয়ায় কোথায় রাখা হয়েছিল, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে আদমকে সরনদীপে (শ্রীলংকা) ও হাওয়াকে জেদ্দায় (সঊদী আরব) এবং ইবলীসকে বছরায় (ইরাক) ও ইবলাসের জান্নাতে ঢোকার কথিত বাহন সাপকে ইস্ফাহানে (ইরান) নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেউ বলেছেন, আদমকে মক্কার ছাফা পাহাড়ে এবং হাওয়াকে মারওয়া পাহাড়ে নামানো হয়েছিল। এছাড়া আরও বক্তব্য এসেছে। তবে যেহেতু কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি, সেকারণ এ বিষয়ে আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।


‘আহ্দে আলাস্ত্ত-র বিবরণ :


মুসলিম ইবনে ইয়াসার (রাঃ) বলেন, কিছু লোক হযরত ওমর ফারূক (রাঃ)-এর নিকটে সূরা আ‘রাফ ১৭২ আয়াতের মর্ম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’লে তাঁকে আমি বলতে শুনেছি যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন।[18] অতঃপর নিজের ডান হাত তার পিঠে বুলিয়ে দিলেন। তখন তার ঔরসে যত সৎ মানুষ জন্মাবার ছিল, তারা সব বেরিয়ে এল। আল্লাহ বললেন, এদেরকে আমি জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছি এবং এরা দুনিয়াতে জান্নাতেরই কাজ করবে। অতঃপর তিনি পুনরায় তার পিঠে হাত বুলালেন, তখন সেখান থেকে একদল সন্তান বের করে আনলেন এবং বললেন, এদেরকে আমি জাহান্নামের জন্যে সৃষ্টি করেছি। এরা দুনিয়াতে জাহান্নামের কাজই করবে। একথা শুনে জনৈক ছাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাহ’লে আর আমল করানোর উদ্দেশ্য কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যখন আল্লাহ কাউকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তিনি তাকে দিয়ে জান্নাতের কাজই করিয়ে নেন, এমনকি তার মৃত্যুও অনুরূপ কাজের মধ্যে হয়ে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। পক্ষান্তরে যখন তিনি কাউকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তাকে দিয়ে জাহান্নামের কাজই করিয়ে নেন। এমনকি তার মৃত্যুও অনুরূপ কাজের মধ্যে হয়ে থাকে। অতঃপর আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান।[19] আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ডান মুষ্টির লোকগুলো ছিল সুন্দর চকচকে ক্ষুদ্র পিপীলিকা দলের ন্যায়। আর বাম মুষ্টির ক্ষুদ্র লোকগুলো ছিল কালো কয়লার ন্যায়’।[20]


উল্লেখ্য যে, কুরআনে বলা হয়েছে, ‘বনু আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে’ (আ‘রাফ ১৭২)। অন্যদিকে হাদীছে বলা হয়েছে, ‘আদমের পৃষ্ঠদেশ’ থেকে- মূলতঃ উভয়ের মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। আদম যেহেতু বনু আদমের মূল এবং আদি পিতা, সেহেতু তাঁর পৃষ্ঠদেশ বলা আর বনু আদমের পৃষ্ঠদেশ বলা একই কথা। তাছাড়া আদমের দেহের প্রতিটি লোমকূপ থেকে অসংখ্য বনু আদমকে বের করে এনে উপস্থিত করানো আল্লাহর জন্য বিচিত্র কিছুই নয়।


মানুষ যেহেতু তার ভাগ্য সম্পর্কে জানে না, সেহেতু তাকে সর্বদা জান্নাত লাভের আশায় উক্ত পথেই কাজ করে যেতে হবে। সাধ্যমত চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হ’লে বুঝতে হবে যে, ওটাই তার তাকদীরের লিখন ছিল। বান্দাকে ভাল ও মন্দ দু’টি করারই স্বাধীন এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। আর এই ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের স্বাধীনতার কারণেই বনু আদম আল্লাহর সেরা সৃষ্টির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। আর একারণেই তাকে তার ভাল ও মন্দ কাজের পরিণতি ভোগ করতে হয়।


এখানে আদমের ঔরস বলতে আদম ও তার ভবিষ্যৎ সন্তানদের ঔরস বুঝানো হয়েছে। এখানে ‘বংশধর’ বলতে তাদের অশরীরী আত্মাকে বুঝানো হয়নি, বরং আত্মা ও দেহের সমন্বয়ে জ্ঞান ও চেতনা সম্পন্ন ক্ষুদ্র অবয়ব সমূহকে বুঝানো হয়েছে, যাদের কাছ থেকে সেদিন সজ্ঞানে তাদের প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল। আর এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ। আজকের বিজ্ঞান একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুর ভিতরে গোটা সৌরমন্ডলীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ফিল্মের মাধ্যমে একটি বিরাটকায় বস্ত্তকে একটি ছোট্ট বিন্দুর আয়তনে দেখানো হচ্ছে। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা যদি উক্ত অঙ্গীকার অনুষ্ঠানে সকল আদম সন্তানকে জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেহে অণু-বিন্দুতে অস্তিত্ব দান করে থাকেন, তবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তাছাড়া জ্ঞানসম্পন্ন না হ’লে এবং বিষয়টি তাদের অনুধাবনে ও উপলব্ধিতে না আসলে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি গ্রহণের ও অঙ্গীকার ঘোষণার কোন গুরুত্ব থাকে না।


প্রশ্ন হ’তে পারে যে, সৃষ্টির সূচনায় গৃহীত এই প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির কথা পরবর্তীতে মানুষের ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাহ’লে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি গ্রহণের ফলাফলটা কি? এর জবাব এই যে, আদি পিতা-মাতা আদম-হাওয়ার রক্ত ও মানসিকতার প্রভাব যেমন যুগে-যুগে দেশে-দেশে সকল ভাষা ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সমভাবে পরিদৃষ্ট হয়, তেমনিভাবে সেদিনে গৃহীত তাওহীদের স্বীকৃতি ও প্রতিশ্রুতির প্রভাব সকল মানুষের মধ্যেই কমবেশী বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের অস্তিত্বই মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দেয় ও বিপন্ন অবস্থায় তার কাছে আশ্রয় গ্রহণের জন্য তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।


তাই তো দেখা গেছে, বিশ্ব ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শাসক ও আল্লাহদ্রোহী ফেরাঊন ডুবে মরার সময় চীৎকার দিয়ে আল্লাহর উপরে তার বিশ্বাস ঘোষণা করেছিল’ (ইউনুস ১০/৯০-৯১)। মক্কা-মদীনার কাফের-মুশরিকরা শেষনবীর সাথে শত্রুতা পোষণ করলেও কখনো আল্লাহকে অস্বীকার করেনি। আধুনিক বিশ্বের নাস্তিকসেরা স্ট্যালিনকে পর্যন্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব মুহূর্তে ‘ওহ মাই গড’ বলে চীৎকার করে উঠতে শোনা গেছে। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির সূচনালগ্নে গৃহীত উক্ত স্বীকারোক্তি প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছে। চাই তার বিকাশ কোন শিরকী ও ভ্রান্ত পদ্ধতিতে হৌক বা নবীদের দেখানো সঠিক তাওহীদী পদ্ধতিতে হৌক।


এ কথাটাই হাদীছে এসেছে এভাবে যে, مَامِنْ مَوْلُوْدٍ إلاَّ يُوْلَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبْوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ اَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ... ‘প্রত্যেক মানবশিশুই ফিৎরাতের উপরে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী-নাছারা বা মজূসী (অগ্নিউপাসক) বানায়’।[21] এখানে ‘ফিৎরাত’ অর্থ স্বভাবধর্ম ইসলাম।[22] অর্থাৎ মানব শিশু কোন শিরকী ও কুফরী চেতনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। বরং আল্লাহকে চেনা ও তার প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের চেতনা ও যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এর ফলে নবীদের প্রদত্ত তাওহীদের শিক্ষাকে সে অত্যন্ত সহজে ও সাগ্রহে বরণ করে নেয়। কেননা শুধু জন্মগত চেতনার কারণেই কেউ মুসলমান হ’তে পারে না। যতক্ষণ না সে নবীর মাধ্যমে প্রেরিত দ্বীন সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় কবুল করে।


ছহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, وَإِنِّىْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ وَأَنَّهُمْ أَتَتْهُمْ الشَّيَاطِيْنُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِيْنِهِمْ... ‘আল্লাহ বলেছেন, যে আমি আমার বান্দাদের ‘হানীফ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ’ রূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তার পিছে লেগে তাকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে নিয়ে গেছে।[23] আল্লাহ বলেন, فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ‘আল্লাহর ফিৎরত, যার উপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর এই সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই’ (রূম ৩০/৩০)।


মোট কথা প্রত্যেক মানবশিশু স্বভাবধর্ম ইসলামের উপরে জন্মগ্রহণ করে এবং নিজ সৃষ্টিকর্তাকে চেনার ও তাকে মেনে চলার অনুভূতি ও যোগ্যতা নিয়ে সৃষ্টি হয়। যদিও পিতা-মাতা ও পরিবেশের কারণে কিংবা শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পরবর্তীতে অনেকে বিভ্রান্ত হয়। অতএব কাফির-মুমিন-মুশরিক সবার মধ্যে আল্লাহকে চেনার ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের চেতনা ও যোগ্যতা বিদ্যমান রয়েছে। এই সৃষ্টিগত চেতনা ও অনুভূতিকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। অর্থাৎ কুশিক্ষা, কুসঙ্গ ও শয়তানী সাহিত্য পাঠ করে বা নষ্ট ব্লু ফিল্মের নীল দংশনে উক্ত চেতনাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করা আল্লাহর সৃষ্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শামিল। অতএব উক্ত সৃষ্টিগত চেতনাকে সমুন্নত রাখাই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য।


একথা ব্যক্ত করে আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنِ- ‘আমি জিন ও ইনসানকে আমার ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন কাজের জন্য সৃষ্টি করিনি’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অর্থাৎ আমি তার প্রকৃতিতে আমার প্রতি ইবাদত ও দাসত্বের আগ্রহ ও যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছি। এটাকে সঠিক অর্থে কাজে লাগালে আমার অবাধ্যতামূলক কোন কাজ বান্দার দ্বারা সংঘটিত হবে না এবং জগতসংসারেও কোন অশান্তি ঘটবে না। যেমনভাবে কোন মুসলিম শিশু জন্মগ্রহণের সাথে সাথে তার কানে আযান শোনানো হয়।[24] অথচ ঐ শিশু আযানের মর্ম বুঝে না বা বড় হয়েও তার সেকথা মনে থাকে না। অথচ ঐ আযানের মাধ্যমে তার হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে যায় তাওহীদ, রিসালাত ও ইবাদতের বীজ। যার প্রভাব সে আজীবন অনুভব করে। সে বে-আমল হ’লেও ‘ইসলাম’-এর গন্ডী থেকে খারিজ হয়ে যেতে তার অন্তর কখনোই সায় দেয় না। তার অবচেতন মনে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্য বোধ অক্ষুণ্ণ থাকে। বিশেষ করে হতাশা ও বিপন্ন অবস্থায় সে তার প্রভুর সাহায্য ও সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।


অর্থ না বুঝলেও কুরআন পাঠ ও আযানের ধ্বনি মানুষের মনকে যেভাবে আকৃষ্ট করে এবং হৃদয়ে যে স্থায়ী প্রভাব ফেলে তার কোন তুলনা নেই। একারণেই কাফির আরব নেতারা মানুষকে কুরআন শুনতে দিত না। অথচ নিজেরা রাতের অন্ধকারে তা গোপনে আড়ি পেতে শুনত এবং একে জাদু বলত। শ্রেষ্ঠ আরব কবিগণ কুরআনের অলৌকিকত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এমনকি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আরবী কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ কুরআন শোনার পর কাব্যচর্চা পরিত্যাগ করেন। গত শতাব্দীর শুরুতে তুরষ্কে ওছমানীয় খেলাফত উৎখাত করে কামাল পাশা ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মসজিদ সমূহে আরবী আযান বন্ধ করে তুর্কী ভাষায় আযান দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু তাতে আরবী আযানের প্রতি মানুষের হৃদয়াবেগ আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে গণবিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি উক্ত আদেশ বাতিল করতে বাধ্য হন।


আধুনিক বিজ্ঞানও প্রমাণ করে দিয়েছে যে, শব্দ মানব মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাই আল্লাহ প্রেরিত আযানের ধ্বনি সদ্যপ্রসূত শিশুর কচি মনে আজীবনের জন্য সুদূরপ্রসারী স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করবে- এটাই স্বাভাবিক। অতএব সৃষ্টির সূচনাকালের গৃহীত ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’ বা আল্লাহর প্রতি ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি মানব মনে জীবনব্যাপী স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যার কথা বারবার বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় এবং যার বিরোধিতা করা আত্মপ্রবঞ্চনা করার শামিল।


‘আহ্দে আলাস্ত্ত-র উদ্দেশ্য :


আল্লাহ বলেন,


أَنْ تَقُولُوْا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ، أَوْ تَقُولُوْا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِّن بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ، وَكَذَلِكَ نُفَصِّلُ الآيَاتِ وَلَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ- (الأعراف ১৭২ -১৭৪)-


‘(আমি পৃথিবীতে আবাদ করার আগেভাগে তোমাদের অঙ্গীকার এজন্যেই নিয়েছি) যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন একথা বলতে না পার যে, (তাওহীদ ও ইবাদতের) এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না’। ‘অথবা একথা বলতে না পার যে, শিরকের প্রথা তো আমাদের পূর্বে আমাদের বাপ-দাদারা চালু করেছিল। আমরা হ’লাম তাদের পরবর্তী বংশধর। তাহ’লে সেই বাতিলপন্থীরা যে কাজ করেছে, তার জন্য কি আপনি আমাদের ধ্বংস করবেন’? আল্লাহ বলেন, ‘বস্ত্ততঃ এভাবে আমরা (আদিকালে ঘটিত) বিষয়সমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করলাম, যাতে তারা (অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা আমার পথে) ফিরে আসে’ (আ‘রাফ ১৭২-১৭৪)।


উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে বুঝা যায় যে, উক্ত প্রতিজ্ঞা ছিল দু’ধরনের। এক- আদিকালে ঘটিত প্রতিজ্ঞা (الميثاق الأزلى ) এবং দুই- অহীর বিধানের আনুগত্য করার জাগতিক প্রতিজ্ঞা (والميثاق الإنزالي الحالي ) যা প্রত্যেক নবীর আমলে তার উম্মতগণের উপরে ছিল অপরিহার্য।



অন্যান্য অঙ্গীকার গ্রহণ :


(১) নবী-রাসূলদের প্রতিশ্রুতি :


‘আহ্দে আলাস্ত্তর মাধ্যমে সাধারণভাবে সকল আদম সন্তানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণের পর আল্লাহ নবী-রাসূলদের কাছ থেকে বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতি নেন; তারা যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্তব্য রেসালাতের বাণীসমূহ স্ব স্ব উম্মতের নিকটে যথাযথভাবে পৌঁছে দেন এবং এতে কারো ভয়-ভীতি ও অপবাদ-ভৎর্সনার পরোয়া না করেন।


(২) উম্মতগণের প্রতিশ্রুতি :


অনুরূপভাবে বিভিন্ন নবীর উম্মতগণের কাছ থেকেও প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়, তারা যেন নিজ নিজ নবী-রাসূলদের আনুগত্য করে ও কোন অবস্থায় তাদের নাফরমানী না করে।


যেমন ছাহাবী উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) সূরা আ‘রাফ ১৭২ আয়াত (অনুবাদঃ ‘যখন তোমার প্রভু বনু আদমের পিঠ সমূহ থেকে তাদের সন্তানদের বের করে আনলেন’)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাদের একত্রিত করলেন এবং নারী-পুরুষে বিভক্ত করলেন। অতঃপর তাদেরকে ভবিষ্যতের আকৃতি দান করলেন ও কথা বলার ক্ষমতা দিলেন। তখন তারা কথা বলল। অতঃপর আল্লাহ তাদের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলেন এবং তাদেরকে নিজেদের উপরে সাক্ষী করে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, হ্যাঁ। আল্লাহ বললেন, আমি তোমাদের একথার উপর সাত আসমান ও সাত যমীনকে সাক্ষী করছি এবং তোমাদের উপর তোমাদের পিতা আদমকে সাক্ষী রাখছি, যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন একথা বলতে না পার যে, এ প্রতিশ্রুতির কথা আমরা জানতাম না।


তোমরা জেনে রাখ যে, আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই ও আমি ব্যতীত কোন প্রতিপালক নেই। আর তোমরা আমার সাথে কাউকে শরীক করো না। সত্বর আমি তোমাদের নিকট আমার রাসূলগণকে পাঠাব। তাঁরা তোমাদেরকে আমার সাথে কৃত এই প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। আর আমি তোমাদের প্রতি আমার কিতাব সমূহ নাযিল করব। তখন তারা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের প্রভু এবং উপাস্য। আপনি ব্যতীত আমাদের কোন প্রতিপালক নেই এবং আপনি ব্যতীত আমাদের কোন উপাস্য নেই। এভাবে তারা স্বীকৃতি দিল। অতঃপর আদমকে তাদের উপর উঠিয়ে ধরা হ’ল। তিনি তাদের দিকে দেখতে লাগলেন। তিনি দেখলেন তাদের মধ্যকার ধনী-গরীব, সুন্দর-অসুন্দর সবাইকে। তখন তিনি বললেন, হে প্রভু! আপনি কেন আপনার বান্দাদের সমান করলেন না? আল্লাহ বললেন, আমি চাই যে, এর ফলে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হউক।


তিনি তাদের মধ্যে নবীগণকে দেখলেন প্রদীপ সদৃশ। তাঁদের নিকট থেকে পৃথকভাবে রিসালাত ও নবুঅতের দায়িত্ব পালনের বিশেষ অঙ্গীকার নেওয়া হয়। যে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমরা নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং আপনার নিকট থেকেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারিয়াম-পুত্র ঈসার নিকট থেকে’ (আহযাব ৩৩/৭)। ঐ রূহগুলির মধ্যে ঈসার রূহ ছিল, যা মারিয়ামের কাছে পাঠানো হয়। উবাই থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত রূহ মারিয়ামের মুখ দিয়ে প্রবেশ করে’।[25]