ইসলামিক বিষয়ের এক বিশাল সমাহার

কিতাবসমূহ

Friday, September 27, 2019

সত্য বলায় শহীদ হলেন তাবেয়ী সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.)


উমাইয়া শাসনামলে ইরাকে এক অত্যাচারী শাসক ছিলেন। নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তিনি ছিলেন নির্মম প্রকৃতির মানুষ। জুলুম-অত্যাচারের জন্য তার ছিল জগৎজোড়া পরিচিতি। প্রজারা তার ভয়ে সবসময় কম্পমান থাকতো। কখন যে কোন ভুলের জন্য কার গর্দান যাবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তবে শাসন পরিচালনায় তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি ‘আরবদের নিরো' হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তবে তার নৃশংসতা ও বর্বরতার ইতিহাসও কম নয়। তিনি কারণে-অকারণে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার লোককে হত্যা করেন বলে ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি হাজ্জাজ আলেম ও সাহাবীদের সাথেও কঠোর ও বর্বর আচরণ করেছেন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কারো সমালোচনা ও প্রতিবাদ মোটেও সহ্য করতেন না। তার অত্যাচারের কেউ প্রতিবাদ করেছে তো তার আর রেহাই ছিল না। এজন্য ইউসুফের শাসনামলে অনেক আলেমকে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে। তখনকার সময় একজন বিখ্যাত তাবেয়ী ছিলেন। তাঁর নাম সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.) হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সীমাহীন জুলুম ও অত্যাচার তাঁর মোটেও সহ্য হলো না। তাই তিনি প্রতিবাদ করলেন। রুখে দাঁড়ালেন অত্যাচারী শাসকের কঠোরতার বিরুদ্ধে। হযরত জোবায়ের (রা.)-এর সাহস দেখে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠলেন। তবে ইউসুফ জোবায়ের (রা.)কে বন্দী করতে পারলেন না। শেষমেশ মক্কার শাসনকর্তা জোবায়ের (রা.)কে গ্রেফতার করে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শাসনকর্তা তাবেয়ীকে সামনে পেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। তার বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। রাগে-ক্ষোভে হাজ্জাজ দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাদশাহ ইউসুফ বন্দীর দিকে ক্ষীপ্রতার সাথে চোখ তুলে তাকালেন। তিনি বন্দীকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম শুনে তাঁকে ও তাঁর মাকে ব্যঙ্গ করে কথা বললেন।
জোবায়ের (রা.) তো মুমিন বান্দা। তিনি জুলুমবাজ সরকারের হুমকিকে পরোয়া করেন না। বন্দীর দৃঢ়তা দেখে হাজ্জাজ বন্দীকে হত্যা করার ভয় দেখালেন।
হাজ্জাজ বললেন, ‘তুমি দেখছি খুবই সাহস দেখাচ্ছো। দেখ, আমি তোমাকে এখনই মৃত্যুপুরীতে পৌঁছে দিচ্ছি'। কিন্তু জোবায়ের (রা.) বললেন,
‘শুনুন আমাদের শাসক! আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আর আপনি শুনে রাখুন, যে জেনেশুনে কোন মুমিনকে হত্যা করে তার পুরস্কার জাহান্নাম। আপনি আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছেন। আজ আপনি যেভাবে আমাকে হত্যা করছেন, আখিরাতে ঠিক তেমনিভাবে আমিও আপনাকে হত্যা করবো।'
হযরত জোবায়েরের কথায় হাজ্জাজ আরও ক্ষিপ্ত হলেন। তার চোখেমুখে বিরক্তি ও ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি বন্দীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আরে বোকা বন্দী, রাখ তোর এসব কথা। এবার বল, তোকে কিভাবে হত্যা করবো?'
বন্দী সাঈদ বললেন, ‘আপনার যা পছন্দ আপনি সেটাই করবেন, এতে আমার কোন পছন্দ বা অপছন্দ নেই।'
এবার হাজ্জাজ বললেন, ‘আমি যদি তোকে ক্ষমা করে দেই, তা হলে কেমন হয়?'
হযরত সাঈদ (রা.) বললেন, ‘হে বাদশাহ‘‘ আমাকে ক্ষমা করা বা হত্যা করার অধিকার আপনার হাতে নেই। আমার প্রভু আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে আপনার কোন কিছু করারই এখতিয়ার নেই। আমাকে হত্যা করেন তো আমি শহীদের মর্যাদা পাবো, আর ছেড়ে দেন তো আমি গাজী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবো। দু'টোই আমার জন্য পরম ভাগ্যের ব্যাপার। আমার হারাবার কিছুই নেই।'
বন্দী সাঈদের কথা শাসক হাজ্জাজের সহ্য হলো না। তিনি প্রচন্ড রেগে গিয়ে জল্লাদকে কাছে ডাকলেন এবং বন্দীকে হত্যা করার হুকুম দিলেন।
জল্লাদ বন্দীকে নিয়ে চললো হত্যা করার জন্য। জল্লাদকে দেখে সাঈদ (রা.) মুচকি হাসলেন।
বন্দীর হাসি দেখে জল্লাদ অবাক হলো। বন্দীকে হত্যা করা হবে, অথচ সে কিনা হাসছে! এ রকম কান্ড জল্লাদ আর দেখেনি। এটা তার কাছে রহস্য বলে মনে হলো। তাই জল্লাদ বন্দীকে আবার বাদশাহর দরবারে ফিরিয়ে নিলো এবং বাদশাহকে সবকিছু খুলে বললো। বাদশাহ হাজ্জাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বন্দী, তুই হাসলি কেন?'
বন্দী সাঈদ বললেন, ‘আমি হাসলাম একজন মুমিনকে হত্যা করার মতো আপনার দুঃসাহস দেখে। আরও এজন্য যে, তোমার ওপর প্রতিশোধ না নিতে আল্লাহতায়ালার ধৈর্য দেখে।'
বন্দীর কথা হাজ্জাজকে আরেকবার উত্তেজিত ও রাগান্বিত করে তুললো।
হাজ্জাজ এবার জল্লাদকে নির্দেশ দিলেন, ‘নিয়ে যাও একে। তাড়াতাড়ি বন্দীর গর্দান উড়িয়ে দাও।'
কোন ভীতি নেই সাঈদ (রা.)-এর মধ্যে। তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন। এবার কিবলার দিকে মুখ করে শান্তভাবে উচ্চারণ করলেন, ‘আমি ঐ পাকজগতের দিকে মুখ করলাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আমি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁরই দিকে মনোনিবেশ করলাম। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।'
হযরত সাঈদের এই কাজও হাজ্জাজের পছন্দ হলো না। তিনি জল্লাদকে বললেন, ‘ওর মুখ কিবলার দিক থেকে সরিয়ে নাসারাদের কিবলার দিকে করে দাও।'
একথা শুনে সাঈদ (রা.) বললেন, ‘তোমরা আমার মুখ যেদিকেই ঘুরাও, আল্লাহতায়ালা সেদিকেই আছেন।'
সাঈদ (রা.)-এর এই সত্য বাণীও বাদশাহ হাজ্জাজের সহ্য হলো না। তিনি বললেন, ‘হে জল্লাদ! এখনই বন্দীকে হত্যা করেন, আর দেরি নয়।'
তারপর জল্লাদ তার কাজ শেষ করলো। হযরত সাঈদ (রা.)কে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা হযরত সাঈদ (রা.) শহীদ হলেন। কিন্তু অত্যাচারী শাসক হাজ্জাজের কাছে মাথা নত করলেন না। অন্যায় ও অসত্যের বিপরীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন তাবেয়ী হযরত সাঈদ বিন জোবায়ের (রা.)।

No comments:

Post a Comment